Poila Baishakh

পয়লা বৈশাখের গল্পগাছা

আমাদের পয়লা বৈশাখ কাটে থিয়েটার চর্চাতেই। লিখছেন ব্রাত্য বসু।বাংলা নতুন বছর এলেই আমার কেন জানি না, কমবয়সের কলেজ স্ট্রিটের হালখাতার কথা মনে পড়ে। অথচ মনে পড়ার উপাদান যে শৈশবে কম তা তো নয়। লিখছেন ব্রাত্য বসু

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৭ ১৭:৫৭
Share:

বাংলা নতুন বছর এলেই আমার কেন জানি না, কমবয়সের কলেজ স্ট্রিটের হালখাতার কথা মনে পড়ে। অথচ মনে পড়ার উপাদান যে শৈশবে কম তা তো নয়। স্কুল, তার ছুটি, পঁচিশে বৈশাখের জন্য নাটকের প্রস্তুতি মহড়া, ফুটবল ম্যাচ, গৃহশিক্ষকের বাড়িতে পড়াতে না আসা, স্কাউটের শিক্ষণ— এই রকম সাত-সতেরো স্মৃতিতে আমার শৈশবই পয়লা বৈশাখ ঠাসা। কিন্তু ওই যে বিকেল সন্ধ্যে হতে না হতেই দূরে, অনেক অনেক দূরে, না জানি কোথায় সেই দিকশূন্যপুর কলেজ স্ট্রিটে বাবার হাত ধরে বাস থেকে নামা ও বিভিন্ন প্রকাশকের দোকানে নিমন্ত্রণে হাজিরা দেওয়া, তাঁদের আপ্যায়ন ও বাবার সঙ্গে গল্পগুজবের মাঝে মিষ্টি তো বটেই, কিন্তু একটা গোটা চ্যাপ্টা বেঁটে কোল্ডড্রিঙ্কসের বোতল পাওয়া ও সেগুলো সাবাড় করা, ভাবলেই এখনও আমার চক্ষু ও রসনা দুই-ই জলপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাবার হাত ধরে ওই সব আশ্চর্য দোকানে আমি ছেলেবেলায় টানা তিন-চার বছর অন্তত তো গেছিই। তাঁরা, অর্থাৎ প্রকাশকেরা তখন আমার কাছে সম্বোধনে পিতৃব্য, অন্যান্য দিন সেই সব কাকারা আমাদের বাড়িতে আমার প্রতি নিস্পৃহ থাকলেও অন্তত ওই পয়লা বৈশাখের দিনটিতে তাঁরা আমার প্রতি ছিলেন অতীব সদয়, নির্বিচারে আমার কলাপাতার প্লেটে মন্ডা-মিষ্টি গুপী-বাঘার ভূতের রাজার আশীর্বাদের মতোই আসতে থাকত। যাই হোক, ছেলেবেলার সেই দিনটির আরও দু’টি গল্প আমার এখনও বেশ মনে পড়ে। তার মধ্যে একটি গল্প করুণ! তা হল এই যে, এক বার আমি ও আমার পাশে বসে আমারই বয়সী আর একটি অচেনা বালক কলেজ স্ট্রিটের কোনও একটি পরিচিত দোকানে বসে যুগপৎ লুচি ও তরকারি সাবাড় করছিলাম। কী ভাবে? বিশেষণ দিতে বললে, বলতে হবে গোগ্রাসে। তো, শেষ লুচিটি যখন আমি মুখে তুলতে যাচ্ছি, পাশের উক্ত বালকটি আমার হাত থেকে সেটি অতর্কিতে ছিনিয়ে নেয়। আমার হাত আমার মুখে ওঠে, কিন্তু সেখানে লুচিটি নেই। তৎক্ষণাৎ আমি তার হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি, কিন্তু সে হাতও তখন ফাঁকা। অর্থাৎ সে লুচিটি ছিনিয়েছে ও পরক্ষণে গলাধঃকরণ করেছে। দোকান ছিল ঠাসা, ফলে আমার বাঁ হাতের মুষ্টি যে তার দিকে সজোরে প্রধাবিত করব, সে উপায়ও নেই। আমি কটমট করে তার দিকে চাইলুম, কিন্তু তার চোখ তখন ভক্তিতে বা সুখে প্রায় নিমীলিত। আর একটি লুচি চাইতে যাব, কিন্তু আমার বাবার সেই প্রকাশকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ তখন শেষ, ফলে বাবা প্রায় জোর করেই হয়তো বা কর্ণ আকর্ষণপূর্বক আমাকে দোকানের বাইরে নিয়ে এলেন। সারা জীবনে এর পর লুচি অনেক খেয়েছি, কিন্তু ওই যে কলেজ স্ট্রিটের বাটার উল্টো দিকে ম্লান বাল্বের আলো, ছোট একটি দোকানের ভিতর পাওয়া, ভিতরে ময়দার পুর দেওয়া দু’ভাগি লুচিটি আজীবনের জন্য ফস্কে গেল, তার স্মৃতি এখনও আমাকে করুণ করে তোলে।

Advertisement

দ্বিতীয় গল্পটি হয়তো মজার, হ্যাঁ মজারই বলা চলে একে। তা হল এই, ওইরকম আরও একটি দোকান থেকে বেরিয়ে অন্য দোকানের দিকে আমরা হাঁটছি, বাবার সঙ্গে ছিলেন বাবারই আর এক লেখক বন্ধু। তো তিনি তৃতীয় কোনও ব্যক্তি প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতেই সজোরে বরাহনন্দনের চলতি বাংলা শব্দটি প্রয়‌োগ করলেন। বাবাও চমকে উঠে আরও বড় অভিব্যক্তিতে তাঁকে বোঝালেন যে সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক আমি আছি। এখন যেহেতু আমার আশ্চর্য স্কুলের দৌলতে ও শব্দটি আমি আগেই শুনে তৎক্ষণাৎ শিখে নিয়েছিলাম, বলাই বাহুল্য, ও শব্দটি আমার কাছে মোটেও অচেনা ছিল না। এখন বাবার চমকানো ও তার জন্য সতর্কতামূলক অভিব্যক্তি আমার ভেতরে মৃদু হাসির জন্ম দিলেও আমি না শোনার ভান করে মোটের ওপর নির্বিকারই ছিলাম। কিন্তু বাবার মনোভঙ্গি লক্ষ্য করে বাবার সেই লেখক বন্ধু আমার কাছে এলেনও। বার বার জানতে চাইতে শুরু করলেন যে আমি কিছু শিখেছি কি না। ভাবলাম, এক বার জিজ্ঞাসা করি কী শিখব, কিন্তু তাতে শব্দটি পুনরুচ্চারিত হতে পারে এই বিবেচনায় তাকে আর কিছু শুধোইনি। পয়লা বৈশাখে কলেজ স্ট্রিটের এই দু’টি শৈশবিক গল্প এখনও আমার স্মৃতিতে টাটকা!

বড় হবার পর আর সকলের মতো আমার কাছেও পয়লা বৈশাখের মানে পাল্টে গেল। আমার কাছে যে মানেটা সবচাইতে বড় হয়ে উঠল তা হল ওই দিন ছুটির দিন, ফলে সকাল থেকে থিয়েটারের মহড়া দেওয়া যেতে পারে। সে সময় আমরা মহড়া দিতামও অনেকক্ষণ ধরে। হয়তো দুপুর তিনটেয় শুরু করে শেষ হত রাত দশটায়। তখন যে দলে কাজ করছি তাতে বেশির ভাগই চাকুরিজীবী, প্রাইভেট ফার্মের করণিক থেকে অটোচালক, প্রাইভেট টিউশন করে দিন গুজরান করা মাস্টারমশাই থেকে কল শ্রমিক, সবাই অভিনেতা। ফলে বেশির ভাগ দিনেই প্রায় সবাই ব্যস্ত, একমাত্র ছুটির দিনে, তাও আবার বিশেষ ছুটির দিনে সবাইকে পাওয়া যায়। আর পয়লা বৈশাখ মানেই যে হেতু অনিবার্য ছুটি, তাই ওই দিনটায় মহড়া হত খুব, এ কথা বেশ মনে পড়ে। তবে ওই যখন কলেজ কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, কি সবে তার গণ্ডি পেরিয়েছে, সেই সময়কার একটি গল্পের কথা এই সূত্রে বলা যেতে পারে। তখন আমি, লাল (সুমন মুখোপাধ্যায়) আর সুপ্রিয়দা (বিশিষ্ট অভিনেতা সুপ্রিয় দত্ত) খুব একসঙ্গে আড্ডা মারি। তো আমরা একবার বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। ঠিক করলাম ওড়িশার সিমলিপাল জঙ্গলে যাব। তখন আমি খুবই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। তো সিমলিপালের পরিকল্পনা আমি মজলিসে পেশ করলাম। তবে আমি আর লাল স্থির করলাম, সুপ্রিয়কে এ তথ্য দেওয়া যাবে না, কারণ তার কাছে বেড়ানোর জায়গা বলতে একমাত্র পুরী, আর ভ্রমণের ক্ষেত্রে সুপ্রিয়দা কোনও রকম নিরীক্ষায় নারাজ। স্থির হল পয়লা বৈশাখের দিন লালের বাড়িতে দুপুরে আমরা দেখা করে, রাতের কোনও একটি ট্রেন ধরে বারিপদা যাব। পরদিন ভোরে বারিপদায় নেমে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে সিমলিপাল যাব। আর ক’দিন বাদেই যেহেতু জঙ্গল বন্ধ হয়ে যাবে, তাই ওই দিন কটিতেই যাওয়া ভাল, এমনটাই ভাবা হল। পরিকল্পনামাফিক দুপুরে আমরা সবাই সাক্ষাৎ করলাম। কিন্তু সত্য বলার সময় যেহেতু ঘনিয়ে এসেছে তাই সুপ্রিয় দত্তকে বলতেই হল যে আমরা উৎকল প্রদেশের জগন্নাথ ধাম নয় বরং হস্তিধাম, চাহালা-বরাইপানি গুড়গুড়িয়া যাচ্ছি। সিদ্ধান্তটি টেবিলে প়ড়া মাত্র সুপ্রিয়দা আঁতকে উঠল। সে নাচার এবং নাছোড়। কিছুতে সে সিমলিপাল যাবে না। অনেকক্ষণ ধরে টানাপড়েনের পর সে যে গল্পটি বলল তা ধ্বংসাত্মক। এবং সেই গল্পটি তারই অনুকরণীয় ভাষায় নীচে তুলে দিলাম—

Advertisement

সুপ্রিয়: ‘‘শোনো ভাই, আমার অফিসের এক কলিগ গত বছর সিমলিপাল গেছিল। ফিরে আসার পর তার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হল।’’

আমরা: ‘‘আহা। জানি তো ওখানে হয়। আমরা তো তার পর্যাপ্ত প্রতিষেধক হিসেবে মশার তেল, ওডোমস ইত্যাদি নিয়েছি।’’

সুপ্রিয়: ‘‘আহা। আমাকে শেষ করতে দাও। তো আমার সেই কলিগ গত বারে সিমলিপাল থেকে ফিরে আসার পর প্রায় এক মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তার পর সে যখন অফিসে জয়েন করল প্রথমেই আমার কাছে এল। এসে বলল, ‘সুপ্রিয়বাবু, আমি সিমলিপাল গেছিলাম। আমার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছিল।’ বলে সে চলে গেল। পর দিন সে আবার অফিসে এসে আমার কাছেই এল। বলল, ‘সুপ্রিয়বাবু, আমি সিমলিপাল গেছিলাম। আমার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছিল।’ তারপর পর দিন আবার এল। একই কথা বলল। তার পরদিনও। তার পরদিনও। তারপর—’’

আমরা: বুঝলাম না ব্যাপারটা কী?

সুপ্রিয়: ‘‘বুঝলে না তো? ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হবার পর ওর মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে যায়। ও এখন বদ্ধ পাগল।’’

বলাই বাহুল্য, এই মোক্ষম গল্পের পর আমাদের আর সিমলিপাল যাওয়া হয়নি। সেই পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যাটি আমাদের কেটেছিল শহরেরই কোনও এক নৈশ রেস্তোরাঁয়।

যাই হোক, হাসিমশকরা ছেড়ে শেষে আবার থিয়েটারের ধানই খানিক ভেনে নেওয়া যাক। এখনও আমাদের পয়লা বৈশাখ কাটে থিয়েটার চর্চাতেই। উত্তর কলকাতার টালা পার্কে একটি তথাকথিত অখ্যাত হল, যার নাম ‘মোহিত মৈত্র মঞ্চ’, সেখানে প্রতি রবিবার আমরা চারটি পৃথক থিয়েটারের দল মিলে চারটি নতুন থিয়েটার করছি, যা শুরু হয়েছে গত মাসে, অর্থাৎ মার্চে। এই চারটি দল হল ‘পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ’, ‘থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম’, ‘ইফটা’, ‘নৈহাটি ব্রাত্যজন’। চারটি প্রযোজনা হল যথাক্রমে ‘বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী’, ‘হৃদিপাশ’, ‘ফোর্থবেল’ এবং ‘একুশ গ্রাম’। চারটি থিয়েটারই নতুন। আর এই চারটি থিয়েটারই এখন ওই মঞ্চেই হবে, তার বাইরে যাবে না। অর্থাৎ উত্তর কলকাতার একটি নির্দিষ্ট মঞ্চকে কেন্দ্র করে আমরা একটি নতুন থিয়েটার-হাব তৈরি করার পরিকল্পনা করেছি। নির্দিষ্ট মঞ্চে নির্দিষ্ট নাট্যাভিনয়— এইটেই এই পরিকল্পনার চিন্তাকোষ। তা হলে আমার আপাত বক্তব্য হল এই যে বাংলার পয়লা বৈশাখ যদি বাংলা মতে উদযাপন করতেই হয় তা হলে ফি রবিবারে আমাদের অভিমুখ হোক টালা পার্কের ‘মোহিত মৈত্র মঞ্চ’। কেননা, কে না জানে, একটা জাতি ঠিক কেমন ভাবে বেঁচেবর্তে আছে, তার গড় বুদ্ধির মান কেমন, তার অন্দর-বাহির, খোলনলচে এ সবের যদি সুলুকসন্ধান করতে হয় এবং তার প্রকৃত পরিচয় পেতে হয় তা হলে থিয়েটারের কোনও বিকল্প তথা নিদান অদ্যাবধি মানবসমাজ পায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন