Poila Baishakh

অভিমানী ১লা

পল্টু বলল, ‘‘ও বাচ্চুদা, পয়লা বৈশাখে একটা প্যাকেটের সঙ্গে জাঙিয়া ফ্রি ছিল না আগের বছর?’’ স্মৃতির পথে রূপঙ্করগনগনে সূর্যের রশ্মি এসে পড়েছে মুখে, গরম লাগতে পারতো খুব। চোখের উপর হাতটা রাখলাম। কুঁচকে যাওয়া চোখের মণি স্থির করে যেই সূর্যের দিকে চাইলাম, দেখলাম তোমাকে...দেখলাম পয়লা বৈশাখ। লিখছেন রূপঙ্কর

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৭ ১৮:২৫
Share:

গনগনে সূর্যের রশ্মি এসে পড়েছে মুখে, গরম লাগতে পারতো খুব। চোখের উপর হাতটা রাখলাম। কুঁচকে যাওয়া চোখের মণি স্থির করে যেই সূর্যের দিকে চাইলাম, দেখলাম তোমাকে...দেখলাম পয়লা বৈশাখ। এইটা কোন সাল? প্রশ্ন এল। কারণ, সত্যিই তো পয়লা আর পঁচিশে বৈশাখ আর শ্রাবণের বাইশে...এই তো বাঙালির বাঙালিয়ানা। লজ্জা হলো এই ভেবে যে পর পর বাংলা মাসগুলো বলতে পারবো তো? নাঃ, এত ভাবার কিছু নেই...বরঞ্চ চোখে সানগ্লাসটা লাগাই...বড্ড অভিমানী এই পয়লা বৈশাখ!

Advertisement

অথচ দেখ, তোমাকেই ভেবে সারা বাংলাদেশে কতই না মাতামাতি। হালখাতা খোলা। নতুন জামা, জুতো, ভালমন্দ খাওয়া...হোক না একদিন...জড়িয়ে রাখি তোমায়, ভরিয়ে রাখি তোমায় সোনামণি...এত অভিমান করে না! তোমার জন্যই তো নমিতা মাসি নকুড়ের জলভরা সন্দেশ আমার মুখে ঠেসে ধরে গালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘‘শুভ নববর্ষ পাপ্পা।’’ খুব রাগ হয়েছিল তখন, কোনও কালেই আমি জড়িয়ে ধরা, গালে চুমু খাওয়া পছন্দ করি না। বলে উঠেছিলাম, ‘‘উফ! কী যে কর না নমিতা মাসি!’’ মা বলে উঠেছিল, ‘‘কেন রে? কী হয়েছে? নমিতা তো তোর মায়েরই মতো? বেশি বাড়াবাড়ি।’’ তুমি এ বছরেও এসেছ। কিন্তু এ বছরে মা নেই, তাই নমিতা মাসিও নেই। ভীষণ ভাবে চাই আজ কেউ জড়িয়ে ধরুক, আদর করুক, চুমু খাক ঠিক যেমন ‘মায়ের মতো’রা করে। একবার তোমায় বরণ করেছিলাম ঢাকায় সোনা। সে কি উৎসব! কি আড়ম্বর! কি উত্তেজনা! ঈদের সময়েও বেশ কয়েকবার ঢাকায় ছিলাম, কিন্তু ‘পহেলা বৈশাখ’-এর সে উত্তেজনা যে একেবারেই আলাদা। রঙের বৈচিত্রে, ভর্তার গরম ভাতে। সে এক অপরূপ কোলাজ। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ভাবতেই পারে না সে বাংলাদেশে ‘পহেলা বৈশাখ’ কী ভাবে উদযাপিত হয়। তাই তো স্বাভাবিক, ভাষার জন্য শহিদ তো ওরাই হয়েছিল! আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি তো শুধু তুমি এলেই তোমাকে ‘ইমপ্রেস’ করার জন্য শুধু আজকেই বাঙালি।

ছোটবেলায় বাটিকের পাঞ্জাবি নিয়ে আসতে তুমি, হ্যাঁ, তুমিই তো আনতে। সেই পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে, গলায়-ঘাড়ে কিউটিকিউরা পাউডার লাগিয়ে, বিকেলবেলা বেরোতাম। শিকদারবাগানের মোড়ে দাঁড়িয়ে তুমিই তো হেসে বলেছিলে, ‘‘মানিয়েছে বেশ।’’ লজ্জা পেয়েছিলাম আমি, আমার সদ্য ওঠা গোঁফদাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেছিলাম, ‘‘ওই আর কি।’’ এর পর হাতিবাগান পর্যন্ত হাঁটা। আবার ফিরে আসা, যদি তুমি তখন শিকদারবাগানের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাক। বোকা ছিলাম...জানতাম না, বাটিকের পাঞ্জাবি সে দিন দেদার ঘুরছে...নানা ডিজাইনে।

Advertisement

‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ এই গানের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী মুখস্থ ছিল আমার আর আমার সব বন্ধুদের। তোমারই স্তুতি। নিশ্চয় তুমিও খুব আয়েশ করতে, এ গলি-ও গলি থেকে রাজপথ মন্দ্রিত হত এই গানে। কেউ সুরে কেউ বেসুরো, কারও মিষ্টি গলা আবার কারও হেঁড়ে! তাতে কি, তোমার স্তুতি কী ভাবে করতে হয় তা আমাদের শিখিয়ে গেছেন রবিঠাকুর।

তোমার মনে আছে সব পেয়েছির আসরের কথা! তোমার জন্য আমরা সবাই পাঞ্জাবি-পাজামা, মেয়েরা শাড়ি পরে জড়ো হতাম সন্ধ্যেবেলা। কেউ গাইতো, কেউ বা নাচতো, কেউ বা করত নাটক। সব পেয়েছির আসরের এই অনুষ্ঠান শুরু হতো ব্রতচারী দিয়ে। সেই ব্রতচারীর দুটি লাইন ছিল এই রকম: ‘‘ছেলেমেয়ে সব সমান এই আসরের রাখবো মান।’’ প্রথম লাইনটিতে আমরা খুব মজা পেতাম, ভাবতাম ছেলেরা-মেয়েরা কি সত্যিই সমান? আমার মা কি আমার বাবার মতো স্বাধীনতা পায়? এই লাইনটা আমরা ততো জোরে বলতাম না। বিশ্বাসের অভাব ছিল। মালবিকাও বলত না, ও ভাবতো আমাদেরই মতো! মালবিকা এখন ১লা বৈশাখে কী করে তা জানি না।

বাচ্চুদার দোকানে গিয়ে সকালে এক বাক্স মিষ্টি খেয়ে এলাম। বাচ্চুদার হোসিয়ারির বিজনেস। পল্টু বলল, ‘‘ও বাচ্চুদা, পয়লা বৈশাখে একটা প্যাকেটের সঙ্গে জাঙিয়া ফ্রি ছিল না আগের বছর?’’ বাচ্চুদা সেই যে পল্টুদাকে তাড়া করল, দোকানে পাহারা দিতে লাগলাম আমরা। এখানেই শেষ নয়, বিকেলে সেই বাচ্চুদা আর পল্টুকে দেখা গেল আর জি করের মুখে দাঁড়িয়ে পয়সার হিসাব করতে, কার কত করে যাবে আজ সান্ধ্যকালীন আসরে। ১লা বৈশাখ বলে কতা!

সুতরাং প্রেয়সী, অভিমান কোরো না। তোমায় আমরা ভালবাসি। আপামর বাঙালি জাত, সে দেশে হোক আর বিদেশে হোক, এই দিনটাতে তো ফেসবুকে Happy New Year না বলে শুভ নববর্ষই বলে। কম কি এটা সোনা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন