ভারত থেকে আন্টার্কটিকায় প্রথম বৈজ্ঞানিক অভিযান হয় ১৯৮১ সালে। প্রথম দু’বছর দলে কোনও মহিলা সদস্য ছিল না। ১৯৮৩ সালে, তৃতীয় আন্টার্কটিকা অভিযানে প্রথম মহিলা বৈজ্ঞানিক নেওয়া হয়। আমি এবং অদিতি পন্থ প্রথম ভারতীয় মহিলা বৈজ্ঞানিক হিসেবে আন্টার্কটিকা যাই।
আমরা গিয়েছিলাম গোয়া থেকে জাহাজে চড়ে। আশি জনের বিরাট দলের অধিকাংশই ছিল সেনাবাহিনীর। সঙ্গে ছিলেন নেভি আর এয়ারফোর্সের কয়েক জন। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল, আন্টার্কটিকাতে প্রথম ভারতীয় রিসার্চ স্টেশন তৈরি করা। আর নেভি, এয়ারফোর্সের কাজ ছিল হেলিকপ্টার করে সদস্য আর মালপত্র পৌঁছে দেওয়া। নানা বিষয়ের বিজ্ঞানী ছিলেন জনা তিরিশেক। গোয়া থেকে জাহাজে করে যেতে সময় লেগেছিল পঁচিশ দিন। রোরিং ফর্টিজ আর ফিউরিয়াস ফিফটিজ-এর উত্তাল সমুদ্র, বরফঢাকা সমুদ্র, যাকে বলা হয় প্যাক আইস, পেরিয়ে আমরা আন্টার্কটিকা পৌঁছলাম ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৩।
অবশ্য অভিযানের শুরুতেই একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। একটা প্রতাপ হেলিকপ্টার জাহাজের ডেক থেকে মাল নিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় জলে পড়ে ডুবে যায়। আরোহীদের সকলকেই উদ্ধার করা হয়েছিল ঠিকই, তবে তাঁদের এক জনের আঘাত ছিল রীতিমত গুরুতর। হাইপোথার্মিয়ার সঙ্গে মেরুদণ্ডেও গুরুতর চোট লেগেছিল। তবে, এত কিছুও আমাদের মনোবল ভেঙে দেয়নি। ঘণ্টা তিনেক পর থেকেই আমরা কাজ শুরু করে দিই।
প্রথম দর্শনের আন্টার্কটিকার কথা মনে ছবির মতো গেঁথে আছে। ঘন নীল আকাশে ঝকঝকে সূর্য। তার নীচে সাদা ধবধবে বরফের চাদরে ঢাকা বিশাল প্রান্তর। এতটা ব্যাপ্তি আমার জীবনে কোথাও দেখিনি। এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে পেঙ্গুইনের দল। চার দিক নিস্তব্ধ। সর্বত্র কেবল দুটি রং— সাদা আর নীল। আমাদের চেনা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ।
আন্টার্কটিকা মহাদেশের শতকরা আটানব্বই ভাগই পুরু বরফের চাদরে ঢাকা। এই বরফের গড় গভীরতা আড়াই কিলোমিটার। কোথাও কোথাও বরফ চার কিলোমিটারেরও বেশি পুরু। শুধুমাত্র পর্বতশৃঙ্গগুলো বরফের গভীরতা ভেদ করে মাথা তুলে আছে।
আমাদের কাজ ছিল এমনই একটি পাহাড়ে— শির্মাকার পাহাড়। আমরা পাঁচ জন বিজ্ঞানীর একটা দল তাঁবু খাটিয়ে সেখানে প্রায় দু’মাস ছিলাম। আমরা যেহেতু ভূতত্ত্ববিদ, তাই রোজই বের হতাম ফিল্ডওয়ার্কে। অন্যরা তাঁবুতেই তাদের গবেষণার কাজ চালাত। তখন ওখানকার তাপমাত্রা শূন্যের বেশ নীচে। প্রচুর গরম জামা আর উপযুক্ত জুতো থাকায় ঠান্ডার মোকাবিলা করা যেত। মুশকিল হত, পাথরের মাপজোখ করতে ক্লাইনোমিটার ব্যবহার করার সময়, বা নোটবুকে কিছু লেখার সময়। মোটা গ্লাভ্স পরে সে সব করা খুবই কষ্টকর। আবার গ্লাভ্স খুললেই হাত ঠান্ডায় জমে যেত। তাই ক্রমাগত গ্লাভ্স খোলা আর পরা!
আরও মুশকিল হত যখন জোরে হাওয়া বইত। আন্টার্কটিকাকে বলা হয় ব্লিজার্ডের বাসভূমি। ব্লিজার্ড বা তুষারঝড় সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তখন তো ফিল্ডওয়ার্ক করা অসম্ভব। তবে তার আগে পর্যন্ত কাজ করতেই হত। হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরফের কুচি মুখের ওপর সূচের মতো বিঁধত। কখনও কখনও আবার হাওয়ার গতিবেগের উলটো দিকে হাঁটতে হলে এগোনোই মুশকিল। ব্লিজার্ডের সময় তাঁবুতে থাকাও কম ঝামেলার ব্যাপার নয়। যদিও তাঁবুগুলো ছিল বিশেষ ধরনের। কিন্তু কিছু ক্ষণ পর পরই তাঁবু থেকে বেরিয়ে, তাঁবুর দড়ি টাইট করে দিতে হত।
আমরা যে সময় গিয়েছিলাম, সেটা ছিল আন্টার্কটিকার গ্রীষ্মকাল। আকাশে সব সময়ই ঝকঝকে সূর্য। দিন আর রাতের বিশেষ তফাত নেই। রাতে অনেক বার ঘুম ভেঙে বাইরে ঝকঝকে দিন দেখে ভাবতাম, বেলা হয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে দেখি, রাত আড়াইটে। এমনটা প্রায়ই হত।
আমাদের নিজস্ব ছোট ছোট তাঁবু ছাড়া বড় একটা মেস টেন্ট ছিল। সেটা ছিল একাধারে কিচেন, বৈঠকখানা আর ল্যাবরেটরি। রোজ রাতে আমরা সেখানে খাবারের প্যাকেট, গ্যাসে বা স্টোভে গরম করে ডিনার সারতাম। প্লেটে খাবার ঢেলেই খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে হত। কারণ নিমেষেই খাবার ঠান্ডা হয়ে য়েত। চা-কফি খাওয়ার সময়ও একই অবস্থা। খাওয়ার পর বাসন ধোওয়াও খুব ঝামেলার কাজ। এক কাপ জলে বাসন ধুতে হবে। তার ওপর গরম জল কাপে নিয়ে ধুতে না ধুতে বরফ হয়ে যায়। ফলে, আমরা টয়লেট পেপার দিয়ে বাসন মুছে সামান্য জলে তা ধুয়ে নিতাম।
তাঁবুতে থাকার সময় স্নান করার প্রশ্নই ওঠে না। মুখ ধোওয়াতেও আলসেমি হত। এক বার আমাদেরই এক জন সহকর্মী গরম জল করে স্নানের তোড়জোড় করলেন। ফুয়েল ড্রাম ঘিরে বাথরুমও রেডি। কিন্তু স্নান শেষে খুব আঁতকে উঠে দেখেন, তোয়ালে থেকে আইসিক্ল ঝুলছে, গায়ে বরফের কুচি!
দ্বিতীয় বার আন্টার্কটিকায় যাই ১৯৮৯ সালে, নবম ভারতীয় অভিযানের সঙ্গে। তত দিনে দক্ষিণ গঙ্গোত্রী রিসার্চ স্টেশন অনেকটাই বরফে ডুবে গেছে। শির্মাকার পাহাড়ে দ্বিতীয় গবেষণা কেন্দ্র ‘মৈত্রী’ উদ্বোধন হয়েছে তার আগের বছর। সে বার তাই ফিল্ডওয়ার্কের সময় আর তাঁবুতে থাকতে হয়নি। আমরা স্টেশনেই ছিলাম।
তবে অভিযানের গোড়ার দিকে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। চার জনের একটি দল— তিন জন জিয়োলজিস্ট আর এক জন নেভি অফিসার, শির্মাকার থেকে আরও দক্ষিণে হামবোল্ট পাহাড়ে সমীক্ষার কাজে গিয়েছিলেন। কথা ছিল দু-তিন দিন বাদে আমিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেব। ওঁরা সবাই মিলে একটা চার জনের তাঁবুতে ছিলেন। তাঁবুর মধ্যে জেনারেটর রাখা ছিল। প্রথম রাত্রেই চার জনই মারা যান কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং-এ। আমাদের সবারই মনের অবস্থা খুব খারাপ। তবুও আমরা ঠিক করলাম, কাজ চালিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে অসুবিধে হল আমার।
তিন জন সহকর্মী চলে যাওয়াতে আমাকে একলাই কাজ করতে হল। যদিও আমাদের দলনেতাও জিয়োলজিস্ট। কিন্তু তাঁকে বেশির ভাগ সময়ই জাহাজে থাকতে হত। আর এই সব অভিযানে প্রত্যেক সদস্যের নিজের নিজের দায়িত্ব থাকে। তাই কারও পক্ষে অন্যকে সঙ্গ দেওয়া সম্ভব নয়।
আন্টার্কটিকায় একা ফিল্ডওয়ার্কে যাওয়া খানিকটা ঝুঁকির ব্যাপার। তখন আমাদের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল না। দুর্ঘটনা ঘটলে, নিজের অবস্থান জানানোর উপায় ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত আমার কাজ ঠিকমতই করতে পেরেছিলাম।
এত সব অসুবিধে সত্ত্বেও আন্টার্কটিকায় কাজ করার আনন্দই আলাদা। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, নতুন জায়গায় কাজ করার উত্তেজনা তো আছেই, তা ছাড়া ওই প্রতিকূলতার মধ্যে সহকর্মীদের সঙ্গে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তা অমূল্য। এ ছাড়া আন্টার্কটিকার সৌন্দর্য তো তুলনাহীন। দ্বিতীয় অভিযানের সময় আমাদের জাহাজ যেখানে নোঙর করেছিল, তার কাছেই সমুদ্রের একটা জায়গায় কতগুলো হিমশৈল এসে জমা হয়েছিল। আমরা ক’জন মিলে একটা রাবার-বোট করে তার কাছাকাছি গিয়েছিলাম। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা! সেগুলো ক্ষয়ে নানা আকার নিয়েছে। কোনওটার মধ্যে গুহা তৈরি হয়েছে, কোনওটা হয়তো খানিকটা ভেঙে পড়েছে। বিরাট বরফের দেওয়াল জুড়ে নানা স্থাপত্য। সাদা আর নীলের কত রকমের বৈচিত্র— ঘন নীল, হালকা নীল, সবজে নীল, উজ্জ্বল নীল আর সাদার সমারোহ। আমরা মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলাম, এ কোন স্বপ্নরাজ্য!