Poila Baishakh

নববর্ষের ভোরে আজও বসে গানের আসর

বনেদি পরিবারগুলিতে সাবেক রেওয়াজ এখনও অটুট। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যসে ছিল এক অন্য নববর্ষ। পুব আকাশে আলোর রেখা ফোটার আগেই জুঁই, বেল আর চামেলির সুবাস মাখা সাদেক আলির সানাইয়ে ভৈরবীর মিঠে সুর ছড়িয়ে পড়ত বড়বাড়ির নহবতখানা থেকে ঘুমে আচ্ছন্ন পাড়াটার আনাচে-কানাচে। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৭ ১৭:৩৪
Share:

চোরবাগান শীল বাড়িতে চলছে পয়লা বৈশাখের পুজো।

সে ছিল এক অন্য নববর্ষ। পুব আকাশে আলোর রেখা ফোটার আগেই জুঁই, বেল আর চামেলির সুবাস মাখা সাদেক আলির সানাইয়ে ভৈরবীর মিঠে সুর ছড়িয়ে পড়ত বড়বাড়ির নহবতখানা থেকে ঘুমে আচ্ছন্ন পাড়াটার আনাচে-কানাচে। ভৈরবীর আলাপ শেষে নাগাড়ায় তাল মেলাতে গলদঘর্ম হতেন বৃদ্ধ চুন্নু মিঞা। ঘুমে আচ্ছন্ন পাড়াপড়শি তখন হয়তো আড় ভাঙতে ভাঙতে ব্যঙ্গ করে ভাবতেন, বড় মানুষের আজব খেয়ালখুশি! বছরের প্রথম দিনটায় অভিজাত পরিবারের পুজোপার্বণ, খানাপিনা থেকে নাচঘরের মেহফিলে থাকত নতুন নতুন চমক। দ্বিগুণ পারিশ্রমিক আর বেশি ইনাম দিয়ে দেশের সেরা বাঈজি বা উস্তাদকে এনে আসর মাতানোই ছিল বাবু-কালচারের ঐতিহ্য। বছরের প্রথম মেহফিলেই অন্যান্যদের টেক্কা দিতে এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর কী-ই বা ছিল? দামি আতরের গন্ধ, গোলাপ জলের মৃদু সুবাস, বিলিতি পানীয় ভরা গেলাসের ঠুংঠাং, আর গানের মাঝে ‘কেয়াবাত’ তারিফ তৈরি করত এক মায়াবী জগৎ। সে দিনের নহবতখানা আজ স্মৃতি। আভিজাত্যের গন্ধমাখা সেই বর্ষবরণের স্মৃতি আজও উসকে দেয় স্মৃতিমদুর বাঙালিদের।

Advertisement

বঙ্গাব্দের উৎস প্রসঙ্গেও বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত। কারও মতে বাংলায় নববর্ষ উৎসবের প্রচলন হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে। কেউ বলেন সুলতান হুসেন শাহ এর প্রচলন করেন। অন্য একটি মত অনুসারে তিব্বতি শাসক স্রাং গাম্পো-র নাম থেকে বাংলা সনের উৎপত্তি। আবার অনেকেই মনে করেন রাজা শশাঙ্ক এই বঙ্গাব্দের স্রষ্টা এবং প্রবর্তক। তবে বঙ্গাব্দের এ উৎস যাই হোক না কেন, বর্তমানে নববর্ষের উৎসবের যে রূপ আমরা দেখতে পাই তার প্রচলন ঘটে পরবর্তী সময়ে।

এখনও হাতে গোনা কিছু বনেদি পরিবারে টিকে আছে নববর্ষের সাবেক রীতি রেওয়াজ। যেমন, নববর্ষের ভোরে আজও গানের আসর বসে চোরবাগান শীল পরিবারে। বছরের প্রথম দিনটা শুরু হয় গৃহদেবতা দামোদর জিউর পুজো অর্চনা দিয়ে। আজও বাড়ির সধবা ও দীক্ষিত মহিলারা পাঁচ রকম ফল, পান-সুপুরি ও পৈতে নিয়ে গৃহদেবতা দামোদর জিউকে দর্শন করে থাকেন। এর পাশাপাশি বাড়ির ছোট-বড় সকলে নিয়ম করেই দামোদর জিউর চক্র দর্শনের জন্য যান।

Advertisement

চোরবাগান শীল পরিবারে গানের আসর

তেমনই শোভাবাজার রাজপরিবারে পয়লা বৈশাখে গৃহদেবতা গোবিন্দ জিউর সেবায়েতদের পালা পরিবর্তনের দিন। এক বছর অন্তর সেবায়েতদের পালা পরিবর্তন হয়ে থাকে। আগে পয়লা বৈশাখে গানের আসর বসলেও, এখন আর সে সব হয় না। তবু পুজোর সাবেক রীতি রেওয়াজ আজও অটুট। অন্যান্য কিছু বনেদি পরিবারে চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত গৃহদেবতাকে ঝারায় বসানো হয়। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত দেবতার গায়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল। দেওয়া হয় বিশেষ বৈকালিক ভোগ। এতে বেল, তরমুজ, খরমুজের পানা বা সরবত দেওয়া হয়। আর থাকে বিভিন্ন রকমের ফল। কোথাও আবার ঠাকুরঘরের জানলায় আজও লাগানো হয় জলে ভেজানো খসখসের পর্দা।

গত তিরিশ বছরে মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে এক অন্যতম আকর্ষণ ছিল টেলিভিশনের পর্দায় নববর্ষের বৈঠক। আজ হাজারো চ্যানেলের ভিড়ে সেই আকর্ষণটাও ফিকে হয়ে এসেছে। তবে বদলায়নি ভোর থেকে মন্দিরে মন্দিরে লক্ষ্মী-গণেশের নতুন মূর্তি আর খেরোর খাতা নিয়ে অপেক্ষমাণ মধ্যবিত্ত বাঙালির সেই আবেগ আর সরল বিশ্বাস।

উত্তর কলকাতার পুরনো বাসিন্দাদের মুখে মুখে আজও শোনা যায় অতীতের নববর্ষের স্মৃতি। দোকানে দোকানে ভিড় জমে যেত এক টাকা বা দু’টাকা জমা দিয়ে লাল খেরোর খাতায় নাম লেখানোর জন্য। দোকানে প্রবেশ করতেই ছেটানো হত গোলাপজল। কিছু কিছু দোকানে ক্রেতাদের খাওয়ানো হত সরবত, ঘিয়ে ভাজা কচুরি আর ছোলার ডাল। সঙ্গে মাটির সরায় দেওয়া হত দরবেশ ও পান্তুয়া। একই রকম ভাবে কমেছে নববর্ষের সন্ধেবেলা উত্তরের পাড়ায় পাড়ায় সেই রকের আড্ডা। আড্ডা নামক বিনোদনকে গ্রাস করেছে হাজারো যান্ত্রিক বিনোদন। অন্য দিকে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ত শহরের নিষিদ্ধ পল্লিতে। সস্তা আতরের উগ্র গন্ধ, বেলফুলের মালা আর কুলফি মালাইওয়ালাদের ডাক অলিগলি হয়ে রাজপথে এসে মিশত।

জামাইষষ্ঠী কিংবা ভাইফোঁটার মতোই নববর্ষ উদ্‌যাপনও যেন ক্ষণিকের বাঙালিয়ানার কৃত্রিম মোড়কে ঢাকা পড়েছে। ধুতি-পাঞ্জাবি কিংবা ঢাকাই জামদানি বালুচরির সাজে অভিজাত রেস্তোরাঁয় বাঙালিখানার প্যাকেজ বুঁদ হওয়া এখন বড়ই সহজ। বাঙালির নববর্ষ আজ শুধুই যেন প্যাকেজ বন্দি এক পার্বণ।

ছবি: সংগৃহীত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন