Refugees

এই পারে ফেলে যাওয়া ছেলেবেলা

তার চার পাশের পৃথিবীটাও খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু তাকেও অল্পে অল্পে বুঝে নিতে হয়েছিল, জীবনের পথে চলতে হয় একাই।

Advertisement

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:৫৯
Share:

যন্ত্রণা: শিয়ালদহ স্টেশনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ভিড়।

এই পুরাতন আখরগুলি
হাসান আজিজুল হক
২৯৯.০০
দে’জ পাবলিশিং

Advertisement

১৯৯৪ সালে একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা নামে একটি বই লেখেন হাসান আজিজুল হক। তাঁর সংশয় জেগেছিল, একাত্তরের ঘটনা নিয়ে ২০-২২ বছর পরে লেখা প্রবন্ধগুলো কেমন হবে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, সমসময়ের নিঃস্ব, ক্লিন্ন, স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির দম্ভে উপদ্রুত বাংলাদেশের ছায়া প্রথম বিজয় দিবসের উত্তাল উন্মাদনার উপর যেন না পড়ে। পাল্টে যাওয়া সময়ে যেন মুক্তিচেতনার বিকৃতি না ঘটে যায়। ডায়েরিও লিখতেন না, স্মৃতিই ভরসা।

Advertisement

যে টুকরোটাকরা, তুচ্ছ স্মৃতি জুড়ে ২০০ পাতার এই পুরাতন আখরগুলি তৈরি করেছেন হাসান আজিজুল হক, সে-ও স্মৃতির ভরসায়। প্রশ্নটা সেখানে আরও গভীর— “ভালো-মন্দ ওই যে সামান্য কিছু ছোটবেলার পড়ার কথা— কী মূল্য তার, কতটুকু মূল্য— কেন লেখা এত সব? আমি অন্তত বলতে পারব না।” আজকের গল্পকার-ঔপন্যাসিক তথা দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকের দিকে তাকিয়ে উত্তরের একটা অনুমান করা যায়। অক্ষর পরিচয় থেকে ১৬-১৭ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনার আয়োজনই মানুষ তৈরির চাবিকাঠি। সেই যাত্রাপথের সঙ্গী হলে প্রাজ্ঞ মানুষটির কাছে পৌঁছোনো যায়।

তাই এই বইয়ের লেখক ঠিক হাসান আজিজুল হক নন— আইজুল। আইজুল পড়ে; পড়তে ভাল লাগে, তাই পড়ে। অঙ্ক ছাড়া পড়ায় মনও আছে, যদিও ইংরেজি একটু খটোমটো লাগে। আইজুল খেলেও; অখাদ্য বুনো কাঁচা বেল দিয়ে ফুটবল, শেওড়াগাছের ঝোপের ভিতর কুমিরডাঙা। আইজুল ভাবে, নুন-মরিচের গুঁড়ো দিয়ে কাঁচা আম যে খায়নি, সে দুনিয়ায় আর খেলো কী? শেষ দুপুরের মারণখিদে পেটে নিয়ে ঠাকুরদিঘিতে স্নান, তার পর ভাত খাওয়া, যতখানি পেটে ধরে। কখনও আলু-পোস্ত আর ট্যালটেলে মাষকলাইয়ের ডাল। তার গ্রামটা বিশাল, যেন শেষ হতে চায় না। ধুলো ভরা চওড়া রাস্তা, দু’পাশে ছোট-বড় মাটির বাড়ি, মাঝে ক্ষীণকায় গলি। বুড়ো পাকুড়তলার ছায়ায় বাস করে সাপ, বাদুড়, শিয়াল। গাছ, দিঘি, মাঠ, ঘাট, মন্দির, মসজিদ, আর কিলবিলে মানুষ নিয়ে একটা পৃথিবী। আইজুলের বাবা তেমন লেখাপড়া না করলেও এক বার কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিককে দেখেছিলেন। “সোজা সাপটা কথা নয়, একজন জ্যান্ত কবিকে তিনি দেখেছেন।” স্কুলে ভর্তি হয়েই আইজুল বোঝে, দুনিয়ায় সে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে বই। মোটা ঢেপসা নয়, চটি বই। খুব ছোটতেই পড়েছিল বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের প্রভাতরবি। গাঢ় হয়েছিল রবীন্দ্রপ্রেম। নানা গোলমালে এক বার স্কুলে যাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়লে কান্না পায়। না যাওয়ার চেয়েও বেশি যেতে ইচ্ছে না হওয়ার বেদনায়।

আইজুলের গল্প শুনতে শুনতে কখনও অপুর কথা মনে পড়ে। প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন, সমাজকেও চেনে কঠোর ভাবে। ছোট থাকতে কিছু কথা তাকে শিখে নিতেই হয়। প্রথম যে দিন স্কুলে যায়, অন্য ছেলেরা অবাক হয়েছিল; একদম ‘হিঁদুদের’ মতো দেখতে! ‘মোচলমানের’ ছেলে যে আলাদাই, বোঝে ক্লাসে ভর্তি হয়ে। পণ্ডিতমশাই পড়াতে পড়াতে পেনসিল চাইলে প্রিয় ছাত্র বাড়িয়ে দেয়। মুখভরা ঘৃণা নিয়ে চমকে ওঠেন তিনি। আইজুল যে পেনসিল জিভে লাগায়, তা তিনি ছোঁবেন? হাসান আজিজুল হক লিখছেন: “সেই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, আমি মোসলমান, আলাদা জাত, হয়তো বা নিচু জাত। বয়েস তো কম, বেশ কষ্ট হয়েছিল।” অথচ মেধাবী ছাত্রটিকে পণ্ডিতমশাই যে কী ভালবাসতেন, তা-ও ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম লেখক। বিপদ খেলার মাঠেও। কাছের বন্ধু অমরেশ হঠাৎ বলে, “হিঁদুপাড়ায় খেলা করবে! যা ভাগ— আমি খুব অবাক হচ্ছি, এরকম করছে কেন তেলা?” বিস্ময়ের পাল্টা ধেয়ে আসে ঢিল। আবার, আইজুলকে বাঁচায় অন্য ‘হিঁদু’ বন্ধু বলা।

বড় হতে থাকে আইজুল। বইয়ের রাশিতে ডুবে যায়, নিজের মতো করে দেখার-ভাবার মন তৈরি হয়। ক্লাস এইটে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায় গোপাল ভৌমিকের পৃথিবীর বড়ো মানুষ। সক্রেটিস পড়তে গিয়ে শেখে নতুন দুটো শব্দ: ‘দর্শন’ আর ‘দার্শনিক’। মনে আঁচড় কাটে; সিদ্ধান্ত হয়ে যায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনই পড়বে। ক্রমশ বর্ধমানের অজ গাঁ যবগ্রামে নিজেকে কুয়োর ব্যাঙ মনে হতে থাকে। “এই বড়ো পৃথিবীটা আসলে নিস্তব্ধ ছিল এতদিন— সন্ধের আকাশের মতো বা তারাজ্বলা অন্ধকার আকাশের মতো। এখন ধারণা হচ্ছে, মহা কলরোলের মধ্যে এই জগৎটা সব সময়েই টগবগ করে ফুটছে।” বড় তাকে হতেই হয়। জানতে হয়, বছর দুয়েক হল পাকিস্তান বলে একটা দেশ হয়েছে, তার অনেক আত্মীয়ই ‘অপশন’ দিয়ে সেখানে চলে গিয়েছে, এই দেশে তারা ‘সংখ্যালঘু’ হয়েছে। এর মর্ম পুরোপুরি বোঝে গ্রাম ছেড়ে খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজে পড়তে যাওয়ার পথে, শিয়ালদহ স্টেশনে। স্তূপীকৃত মানুষ দেখে মনে হয়, “পূর্ব পাকিস্তানের স্টেশনগুলো হয়তো এমনি করেই মুসলমান রিফ্যুজি দিয়ে ভর্তি হয়ে আছে!”

বিভক্ত ভারতের যবগ্রামে আইজুলের বাল্যকাহিনি পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় নীলু নামে এক কিশোরের কথা, প্রায় কাছাকাছি সময়ে যে বেড়ে উঠেছিল পদ্মানদীর পাড়ে। তার চার পাশের পৃথিবীটাও খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু তাকেও অল্পে অল্পে বুঝে নিতে হয়েছিল, জীবনের পথে চলতে হয় একাই। সকালবেলার আলো, সুপুরিবনের সারি ও শহরপথের ধুলো সিরিজ়ে শঙ্খ ঘোষের চোখে আমরা তাকে চিনি। আইজুল আর নীলুর যাত্রা একই পথে, অভিমুখ বিপরীত।

সত্তর বছর বয়সে পৌঁছে স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন হাসান আজিজুল হক। গল্প-উপন্যাসে বার বার তাঁর জীবনের ছায়া পড়ে। বলেন, বাস্তব বাদ দিয়ে ভাবতে পারেন না, উদ্ভাবন করতে পারেন না। প্রথম দিকে লেখালিখির জন্ম দৈনিক যাপন থেকেই। যা দেখেছেন বা করেছেন বা ঘটে গিয়েছে, তা-ই লিখেছেন। শকুন গল্পে গরু-চরানো স্কুলছাত্রেরা আইজুলেরই দলবল। বৃদ্ধ বয়সে সেই আত্মস্মৃতিই লেখেন সাজিয়ে-গুছিয়ে, চার খণ্ডে— ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত, এই পুরাতন আখরগুলি এবং দুয়ার হতে দূরে। বাল্য, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ার শেষ দুই খণ্ড একত্রে ধরা আছে এ পারের প্রকাশনাটিতে।

হাসান আজিজুল হকের সেলুলয়েড-স্বরূপ বর্ণনার দক্ষতা বহু আলোচিত। এ কেবল পাহাড়প্রমাণ স্মৃতির ব্যাপার নয়, এক রকম ফিরে দেখাও— রাজশাহী-নিবাসী প্রবীণ দর্শনের অধ্যাপক দেখছেন ষাট বছর আগেকার এক অপরিপক্ব কিশোরকে। পৃথক কালপর্ব, পৃথক ভূগোল, পৃথক মানুষ। সাহিত্যতত্ত্বের এক মত বলে, আত্মজীবনী বলে কিছু হয় না, আর পাঁচটা মানুষের মতো তিনিও স্বয়ং দূর থেকেই দেখেন ফেলে আসা মানুষটিকে। এ বই পড়ে সেই উপলব্ধিই হয়। গ্রাম্য প্রকৃতির অজস্র খুঁটিনাটি দেখার জগতের মতোই এগিয়ে চলে, রং পাল্টায় ঋতুতে ঋতুতে। সবই বড় দরদ দিয়ে দেখে এসেছে আইজুল, পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন হাসান আজিজুল হক। এর মধ্যে দিয়ে শরীর-মনে বেড়ে ওঠা আর চার পাশ বদলে যাওয়া— আস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা।

হাসান আজিজুল হকের নির্বাচিত গল্প-এর ভূমিকায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, এতখানি লিখেও বলা সম্ভব নয়, হাসান কেমন। সে প্রয়াস অক্ষম। তাঁকে জানার শ্রেষ্ঠ উপায়, তাঁকে পড়ে ফেলা। অনাবিল গল্প বলার ভঙ্গি, তরতর করে এগিয়ে চলা। অভিজ্ঞতাঋদ্ধ এক প্রবীণ মানুষ সবার সামনে ঝুলি উপুড় করে দেন, আর সবাই গোগ্রাসে গেলে। তাঁর ভাষা কেমন, বলতে হয় তাঁর গদ্য ধার করেই: ‘নিতান্তই সরল সহজ’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন