মাদার টেরিজা। ফাইল চিত্র।
মাদার টেরিজার সঙ্গে আমার দুটো জায়গায় মিল। আমরা দু’জনেই কলকাতার। এবং দু’জনেই ক্যাথলিক। এমনটা নয়, আমি খ্রিষ্টান বলে এই কথাটা বললাম। এমন একটা বাড়িতে আমি বড় হয়েছি, যেখানে গির্জায় যাওয়া, একই সঙ্গে পাশের দুর্গাপুজো কমিটির অংশ হয়ে ওঠা কিংবা ইদের সময় বাবার ঘনিষ্ঠ ইসলাম ধর্মাবলম্বী বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া— এগুলো সবই জরুরি ছিল। আমি ঈশ্বরকে গুরুত্ব সহকারে দেখলেও ধর্মীয় পরিচয়কে গুরুত্ব দিইনি। এই শহর এবং সারা বিশ্বের অন্যদের মতোই মাদারের কাজ এবং তাঁর নানদের নিঃস্বার্থ সেবাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখি।
সেটা ১৯৯১ সাল। মাদার টেরিজা, মানুষের সেবা এ সবের থেকে আমি তখন অনেকটাই দূরে। জীবনের একটা বাঁকে দাঁড়িয়ে তখন। বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ‘ওগিলভি অ্যান্ড ম্যাথার’ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওই বিজ্ঞাপনী সংস্থায় তিন বছর ক্রিয়েটিভ হেড হিসাবে কাজ করেছি। বেশির ভাগ সপ্তাহান্ত কেটে যেত কুইজের আয়োজন করে। কেন জানি না আমার মনে হয়েছিল, একটা সংস্থা তৈরির এটা একটা সুযোগ। কুইজের দক্ষতাও কাজে লাগানো যাবে, আবার জ্ঞান অর্জনের বিষয়টা নিয়ে ব্যবসাও করা যাবে। ফলে জ্ঞান অর্জনের বিষয়টাকে উৎসাহব্যঞ্জক করে মানুষকে সাহায্য করা এবং ব্র্যান্ডটাকেও মজবুত করার কথাই ঠিক করলাম।
আমার বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা নিশ্চিত ছিল না। ওরা বুঝতে পারছিল না, কেন একটা নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে দিতে চাইছি? কেন মাথায় উদ্যোগপতি হওয়ার পোকা ঘুরঘুর করছে, সেটাও বুঝতে পারছিল না। আমি তখন লক্ষ্যে স্থির, এটা করবই। শখকেই আমার পেশা করব। ‘ওগিলভি অ্যান্ড ম্যাথার’ আর ‘বিগ আইডিয়াজ’ (নতুন যে সংস্থা তৈরি করছিলাম) থেকে তিন মাসের ছুটি নিলাম। ওই সময়টাকে অর্থবহ কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জানতাম না যে, কী করতে চাই। কিন্তু ভিতরে কোথাও যেন মনে হচ্ছিল, মননের জন্য একটু সময় প্রয়োজন। প্রাপ্তি মেটানোর প্রয়োজন।
একদিন আলোকচিত্রী সুনীলকুমার দত্ত আমায় দেখতে এলেন। আমি বহু বছর ওঁকে চিনি। আমার থেকে বয়সে উনি বড়। কলকাতার ক্রনিকলার এবং এ শহরের নানা আবহকে তুলে ধরার জন্য বেশ বিখ্যাত সুনীল। কলকাতার এক সেট সাদা-কালো ছবি ছিল তাঁর কাছে। বইয়ের প্রকাশকের কাছে বিক্রি করতে চাইছিলেন সেগুলি। আমি কি ওঁকে সাহায্য করতে পারি? সেরা ছবিগুলো বাছাই করে দিতে হবে। আমার কাছে ছবিগুলো রেখে গেলেন বইয়ের জন্য সেরা ছবিগুলো বেছে দেওয়ার জন্য। আমার পছন্দে ভরসা করেছিলেন সুনীল। পারিশ্রমিক হিসেবে দেড় লক্ষ টাকা দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকলেন।
আরও পড়ুন: ধর্মনিরপেক্ষ হলে তুরস্কে কেন? এ বার সঙ্ঘের রোষে আমির খান
আমি ছবিগুলো দেখছিলাম, অসাধারণ কাজ ওঁর। নতুন করে ছবিগুলো থেকে কিছু পাচ্ছিলাম না। কলকাতা আ ওয়েল ক্রনিকলড সিটি। এর উপর অজস্র বই আর ছবির কাজ রয়েছে। সুনীলের ওই ছবিগুলো নতুন আঙ্গিকে সামান্য কিছু মাত্রা যোগ করবে বা শহরটাকে অন্য আকৃতি দেবে।
যখন সুনীলের সঙ্গে আমার আবার দেখা হল, আমি খোলাখুলি বললাম। ওকে একদম বিমর্ষ লাগছিল। ‘‘আমার টাকাটা দরকার।’’ কেন সুনীলদা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম। ‘‘এটা তো অনেকটা টাকা। এটা কেন দরকার?’’ আমার মুখের উপর জবাব এল, ‘‘ডেরেক আমার মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা দরকার।’’ একটা মানুষ, এক জন শিল্পী, সারা জীবন যিনি ক্যামেরাকে উপাসনা করেছেন আর বিষয়কে, তোয়াক্কা করেননি টাকার। এখন আদরের মেয়ের বিয়ের জন্য এই টাকাটা দরকার। তাঁর কিছু নেই, কোনও সম্পত্তি নেই, বছরের পর বছর ধরে তোলা ছবিগুলো ছাড়া।
অর্থবহ কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম আমি। এমন কিছু, যেটা একেবারে অন্য রকম। আমি পেয়ে গিয়েছি। সুনীল। আমি বললাম, বইটা হবে, বিয়েও হবে। চিন্তা করবেন না। আমি বললাম, কলকাতার উপর বইটা ভাল ভাবনা নয়। তার পর মাথায় একটা বড়সড় ঝড় বইল। আমি ওঁকে বললাম, আমায় এমন কোনও মহিলার ছবি দেখান, যাঁকে উনি রীতিমতো তাড়া করে বেরিয়েছেন ছবি তোলার জন্য, যাঁর পিছু ছাড়েননি, দশকেরও বেশি সময় ধরে। মাদার টেরিজা। তাঁকে নিয়ে কোনও বই রয়েছে?
সুনীল ওঁর তোলা মাদার টেরিজার ছবি নিয়ে এলেন। সাদা-কালো কাজ, কিছু সাধারণ, কিছু অপূর্ব, কিছু মাস্টারপিস। মাদার প্রার্থনা করছেন, মাদার এক জন দুস্থ শিশুকে সাহায্য করছেন, অন্যায় ভাবে কোনও দরিদ্রকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ, তাঁর মুক্তি নিশ্চিত করে পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছেন মাদার। সহজাত ভাবেই আসলে জানতাম, আমাদের একটি বই আছে।
প্রথমেই আমি যেটা করলাম, ওগিলভি অ্যান্ড ম্যাথার থেকে দেড় লক্ষ টাকা তুলে নিলাম, সুনীলকে দিলাম। বইটাকে দাঁড় করাতে হবে, যদিও মাদারের উপরে বইয়ের অভাব হয়নি। সুনীলের সঙ্গে এক দিন কথা বলতে বলতে মনের মধ্যে জোরালো একটা ভাবনা এল, ওই আলোকচিত্রগুলির জন্য ভাল শিরোনাম জরুরি। কেন মাদার নিজেই ওগুলো লিখবেন না? মনে মনে প্রার্থনা করে মাদার টেরিজার সঙ্গে একটা সাক্ষাতের দিন চাইলাম।
মাদার হাউজে সেটাই আমার প্রথম বার যাওয়া। মূল প্রবেশদ্বারে একটা ফলকে লেখা ছিল মাদার টেরিজা। সঙ্গে লেখা ‘ভিতর’ ও ‘বাহির’। যদি তিনি বাড়িতে থাকেন, তা হলে ‘বাহির’ লেখাটা ঢাকা থাকত একটা ছোট শাটার দিয়ে বা অন্যটা হলে বিপরীত। ঘটনাচক্রে, ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে মাদার টেরিজার মৃত্যুর পর মাদার হাউজের প্রবেশ পথে (এখন যেখানে মাদারের সমাধি শায়িত), লেখা মাদার টেরিজা…‘ভিতরে’।
আমি বইয়ের বিষয়টা মাদার টেরিজাকে বললাম। উনি রাজি হলেন না। আর একটা বই কেন?
‘‘আপনার কাজের কথা মানুষের কাছে পৌঁছবে’’, আমি বললাম। উনি হাসলেন। সহানুভূতির সঙ্গে বললেন, ‘‘দেখ বাবা, ঈশ্বর করুণাময়, মানুষ আমাদের কাজ সম্পর্কে জানে।’’
ওঁকে বললাম, আমি বইটার বিজ্ঞাপন আনার পরিকল্পনা করেছি। তাঁরা ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’কে পাঁচ লক্ষ টাকা দান করবেন। আমরা শুধু ওঁর আশীর্বাদ চাই। আর ওঁর হাতে লেখা শিরোনামগুলো।
মাদার ওঁর সহকর্মী সিস্টার প্রিসিলার দিকে তাকালেন, তিনি মাথা নাড়লেন। কিন্তু বললেন, ‘‘শিরোনাম লেখার সময় নেই’’, ‘‘এত বছর ধরে অনেক কিছু বলেছি’’— এ কথা বলে তিনি বললেন, ‘‘ওগুলোই ব্যবহার করছ না কেন?’’ কাজটার জন্য সেটা সবুজ সঙ্কেত হলেও সেটা আমার জন্য বিশাল চাপ। শ’য়ে শ’য়ে প্রবন্ধ এবং বই-বক্তৃতার মাঝখান থেকে সঠিক উদ্ধৃতি এবং পঙ্ক্তি খুঁজে বার করতে হবে, যা উনি বলেছেন।
আমি যখন চলে যাচ্ছি, সিস্টার প্রিসিলা আমায় বললেন, ‘‘মাদারের মন জয়ের কারণটা কী?’’ মাদারকে নিয়ে এত বই লেখা হয়েছে কিন্তু প্রথম বার কেউ ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-র জন্য কিছু করতে চাইলেন।
আরও পড়ুন: ভারতীয় পড়ুয়াদের পাশে গ্রেটা থুনবার্গ, জেইই-নিট পিছনোর দাবিকে সমর্থন
আমাকে এ বার বিজ্ঞাপনদাতা খুঁজতে হবে, যাঁরা মাদারের বইটির কাজ করবে, যে বইয়ে মাদারের ছবিকে বর্ণনা করা হয়েছে মাদারেরই কথায়। সিটিব্যাঙ্ক রাজি হল। মিশনারিজ অব চ্যারিটিকে তারা পাঁচ লক্ষ টাকা দিল, বই ছাপা ও সামগ্রিক খরচাও বহন করল। দেশে সিটিব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রধান জয়তীর্থ জেরি রাও বইয়ের ভূমিকা লিখতে রাজি হলেন। আমি শিরোনাম খুঁজে সেগুলোকে ছবির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বসানোর কাজ করলাম। বইটা ছাপতে যাবে তখন সিটিব্যাঙ্ক ফোন করে বলল, তাদের এশিয়ার (হংকং) প্রধান এটি লিখবেন। কয়েক দিন পর ফের বদল, সিটিব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক প্রধান (নিউ ইয়র্ক) এটি লিখবেন, মাদারের আর্তি সব মহাদেশ জুড়ে।
তার পর এল সেই দিন। সিটিব্যাঙ্কের শীর্ষ কর্তাদের উপস্থিতিতে, (এঁদের মধ্যে ছিলেন দেশের প্রধান যিনি মুম্বই থেকে এসেছিলেন, এশিয়ার প্রধান যিনি হংকং থেকে এসেছিলেন) মাদার টেরিজা স্বয়ং বইয়ের উদ্বোধন করলেন। চেক নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। এসেছিলেন মাদার টেরিজা, কলকাতার জীবিত সন্তের তীর্থে তীর্থযাত্রী হয়ে। ছিলেন সুনীল দত্তও। টেনিস তারকা নরেশ কুমার ও তাঁর স্ত্রী সুনীতাও ছিলেন মাদার ঘনিষ্ঠ অনুরাগীদের মধ্যে।
সবাই মাদার হাউজে পৌঁছলাম। মাদারের বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছি। কিন্তু, মাদার বেরিয়ে এলেন না। তবে তাঁর বাণী এল। সিস্টার প্রিসিলা ভিতরে গেলেন, তার পর খানিকটা ভয় পেয়েই ঘামতে আমি মাদারের ঘরে গেলাম। তাঁকে অনুরোধ করলাম বইটি প্রকাশের জন্য। তিনি বললেন, কোন বই? আমি থতমত খেয়ে জিভ জড়িয়ে তাঁকে মনে করালাম আগের সাক্ষাতের কথা। ‘‘ব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তারা এসেছেন মাদার,’’— অনুনয়-বিনয় করে বললাম। ‘‘তাঁরা আপনার আশীর্বাদ চান এবং আপনি তাঁদের থেকে চেকটা গ্রহণ করুন সেটাও।’’ মাদার হাসলেন, দুষ্টুমির হাসি। একেবারে শিশুর মতো। ‘‘আমি নিশ্চিত আমরা ওঁদের একটা অ্যাম্বুল্যান্সের কথা বলতেই পারি। পারি না? সবার উপরে, এটা তো ঈশ্বরের কাজ।’’ এর পর বেরিয়ে এলেন সেই মহীয়সী। যাঁরা এসেছিলেন, সবাইকে অভ্যর্থনা জানালেন, বইয়ের প্রথম কপিটার মোড়ক খুললেন। চেকটা নিলেন, ধন্যবাদ জানালেন। তার পর যোগ করলেন, প্রায় শেষ মুহূর্তে, ‘‘আমি নিশ্চিত, আমাদের বন্ধুরা আমাদের একটা অ্যাম্বুল্যান্স দিতেই পারেন আর্তের সেবার জন্য।’’
হংকংয়ের কর্তা সম্মত হলেন একবারেই। তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না। ভাল ভাবেই সম্পন্ন হল সবটাই। বইটা সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। প্রায় বাতাসে ভাসতে ভাসতে ফিরলেন সিটি ব্যাঙ্কের কর্তারা। সুনীলদার মেয়ের বিয়ে হল। ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি পাঁচ লক্ষ টাকা এবং একটা নতুন অ্যাম্বুল্যান্স পেল। আর আমার জন্য, তিন মাসের সেই বিরতি একটা সত্যিকারের কাজে এল। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন উপকারে এল ওই প্রকল্পটা। আমি খুব একটা বিশ্বাসী নই, কিন্তু মাদারের উপস্থিতির অনুভব করেছি। আমি মাদারকে ফোন করতাম এর পর। আমার পেশাগত কাজে তাঁর আশীর্বাদেরও অবদান রয়েছে।
(লেখক তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার দলনেতা)