পাহাড় চুরি

তদন্ত করিয়া বলা হয়তো যাইতে পারে, যাহা ছিল জনগণের সম্পদ, কে বা কাহারা তাহা লুট করিল। হিসাবনিকাশ করিয়া সেই পাথরের বাজারদরও মিলিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
Share:

পুকুর চুরি তো হরদম হইতেছে। এ বার পাহাড় চুরি গেল রাজস্থানে। দুই-একটি নয়, আরাবল্লি পর্বতমালার একত্রিশটি পাহাড় ‘নিখোঁজ’। যাহা ছিল পাহাড়, তাহা হইয়াছে খাদ। কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্ত দল এমনই রিপোর্ট দিয়াছে। অতঃপর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধ করিবার নির্দেশ দিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। রাজস্থানের মুখ্য সচিব হয়তো আজ্ঞাপালনের প্রমাণও পেশ করিবেন যথাসময়ে। কিন্তু চোরও পালাইয়াছে, চোরাই মালও বিলকুল গায়েব হইয়াছে। এখন সেপাই পাঠাইয়া কী লাভ? তদন্ত করিয়া বলা হয়তো যাইতে পারে, যাহা ছিল জনগণের সম্পদ, কে বা কাহারা তাহা লুট করিল। হিসাবনিকাশ করিয়া সেই পাথরের বাজারদরও মিলিতে পারে। কিন্তু গাছের মূল্য যেমন কাঠ দিয়া হয় না, নদীর মূল্য সেচের জল কিংবা মাছের পরিমাণ দিয়া মেলে না, তেমনই পাহাড়ের মূল্য পাথরের বর্গফুটের মাপে ধার্য করা সম্ভব নহে। পাহাড়-উপত্যকা, নদী-সরোবর, পলিমাটি কিংবা বালুকা, পৃথিবীর বিচিত্র প্রাণসম্পদের সহিত এই নিষ্প্রাণ বস্তুগুলির কত সূক্ষ্ম এবং নিবিড় সম্পর্ক, তাহার ব্যাখ্যা প্রায় অসম্ভব। সুপ্রিম কোর্ট সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছে, সম্ভবত আরাবল্লি পর্বতমালার পাহাড়গুলি নিশ্চিহ্ন হইবার জন্যই দিল্লিতে দূষণ বাড়িতেছে। দূষণের কী বিপুল মূল্য ভগ্নস্বাস্থ্যের মুদ্রায় চুকাইতে হয়, কাহারও অজানা নাই। বড় বড় শহরগুলিতে জনজীবন কার্যত স্তব্ধ হইয়া যাওয়ায় শিল্পবাণিজ্যের ক্ষতিও যথেষ্ট হইয়া থাকে। বেজিং ও দিল্লি, দুইটি শহরের দিকে তাকাইলেই স্পষ্ট হয়, দূষণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতোই ভয়ানক হইতে পারে।

Advertisement

কিন্তু দূষণই কি একমাত্র বিবেচ্য? সম্প্রতি এক প্রাবন্ধিক আক্ষেপ করিয়াছেন, মানুষ প্রকৃতি হইতে যত দূরে সরিতেছে, ততই পরিবেশ লইয়া আলোচনা বাড়িতেছে। কথাটির মধ্যে সত্যতা আছে। প্রকৃতির নির্মাণ ও প্রাকৃতিক নিয়মকে যথাসম্ভব নস্যাৎ করিয়া পরিবেশের অবনতি লইয়া মাথা ঘামাইতে মানুষের জু়ড়ি নাই। বহু সহস্র বৎসর ধরিয়া অল্পে অল্পে প্রকৃতি পর্বত নির্মাণ করিয়াছে, এবং তাহার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়া বিচিত্র প্রাকৃতিক এবং প্রাণসম্পদ গড়িয়া উঠিয়াছে। মাত্র কয়েক দশকে সেই প্রাচীন পাহাড় নিশ্চিহ্ন হইয়া গেলে পরস্পর-সম্পৃক্ত প্রাণিজগতের উপর কী প্রভাব পড়িতে পারে, তাহা না বুঝিবার কথা নহে। প্রাণশৃঙ্খলের একটিও সংযোগ ছিঁড়িয়া গেলে তাহার ফল হইবে সুদূরপ্রসারী। আক্ষেপ, বিজ্ঞানের এই সব সতর্কবার্তা বিভিন্ন রাজ্যের সরকার বরাবর অবজ্ঞা করিয়াছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদগুলি নিধিরাম সর্দারের ভূমিকায় দণ্ডায়মান থাকিয়াছে। পরিবেশ আদালতের ভর্ৎসনা নীরবে উপেক্ষিত হইতেছে। পশ্চিমবঙ্গের নদীখাত হইতে বালি লুণ্ঠন হইতেছে, রাজস্থানের পাহাড় হইতে পাথর।

তবে শুধুমাত্র সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া লাভ নাই। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশিতা, সকল বিষয়ে সাধারণ নাগরিক যে কত উদাসীন তাহা প্লাস্টিক ব্যবহারের আগ্রহ দেখিলেই স্পষ্ট হয়। সম্প্রতি গবেষকরা দেখিয়াছেন, মনুষ্যবর্জ্যেও প্লাস্টিক মিলিয়াছে। অর্থাৎ প্লাস্টিকের কণা প্রবেশ করিতেছে দেহে। ইহাই হয়তো প্রকৃতির প্রতিশোধ। অপরকে যে ধ্বংস করে, নিজের সর্বনাশ হইতে সে খুব দূরে নাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন