বা ঙালিদের দুর্গাপুজো ছিল, মরাঠিদের গণেশপুজো, কিন্তু সারা ভারতের সক্কলের একটা শ্রেষ্ঠ উৎসব তো আর ছিল না। সেটা আমি চালু করলাম। এখন আইপিএলের স্লোগান দেওয়া হয়, ‘এ হল ভারতের উৎসব।’ যে বিরাট দেশটার এক প্রান্ত থেকে আর একটা প্রান্ত কুকুর আর বেড়ালের মতো মিল-হীন ও শত্রু-ফোঁসফোঁস, যাকে একটা মাত্তর সুতোয় বেঁধে ফেলাটা স্রেফ কয়েকটা বায়বীয় গানের আস্ফালন ও ফ্যান্টাসি ছাড়া কিচ্ছু নয়, তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধলাম আমিই, টাইট নারকোল দড়ি দিয়ে। এখন প্রতিটি ভারতীয় সন্ধেবেলা আইপিএল দেখতে বসে, সে কাশ্মীরিই হোক, আর কুমারী কন্যা। এই রে, একটু গুলিয়ে গেছে। তা, আমি তো জিয়োগ্রাফিতে ডক্টরেট করিনি, বিদ্যেবুদ্ধির সিলেবাসে আমার কিচ্ছু এসেও যায় না, আমি নিজেই ইতিহাসের ক্যারেক্টার— ভারতের একমাত্র ঐক্য-কর্তা। গাঁধী? ছো! বড় বড় কথা আর ছোট ছোট ড্রেস মিলিয়ে ইমেজটা ভালই করেছে, কিন্তু কাজকম্মের নেট রেজাল্টটা কী? একটা বিরক্ত, কনফিউজ্ড ভারত। অহিংসাকে যে ব্যঙ্গ করে, সত্যের প্রতি যার মিনিমাম আগ্রহ। আর আমার অবদান? একটা গোটা সিজন, সূর্যাস্ত হতে না হতে, একটা অসম্ভব বিশাল দেশ এক কোরাসে গলা মিলিয়ে, একটাই ধড়ক-ধড়ক দিল-এর চারপাশ ঘিরে ম্যাপটা টাঙিয়ে নিচ্ছে। এই সময় ভারতীয়রা চুরির কথা ভাবে না, সিরিয়ালের কথা ভাবে না, এমনকী প্রেমের কথাও না। তাই দোকানপাটও সেফ, পপুলেশনও কন্ট্রোলে। আমায় খানপনেরো ভারতরত্ন দিলে হত না?
শত্তুরগুলো এখন ঘোটালাবাজ দুর্নাম দিয়ে আমায় তাড়িয়ে ছেড়েছে, আমারই কীর্তি হাইজ্যাক করে, তারই চাকায় সওয়ার হয়ে বগল বাজাচ্ছে। আমি মিটিমিটি হাসি, সেল্ফি তুলি, আর নিজের বুদ্ধির কথা ভাবি। সব লোক ব্যবসা করে, কিন্তু আমি হিরে-নজরের ছিপ দিয়ে তুলে নিলাম একটা অদ্ভুত চকচকে বস্তু: যুগলক্ষণ। চার পাশে তাকিয়ে দেখলাম, মানুষের এখন আর সময় নেই। কেন নেই? সে কি পেছন তুলে কাজ করছে? সে কি অফিসে এমন হুমড়ি খাচ্ছে যে ভারতের উৎপাদন পাঁইপাঁই বাড়তে বাড়তে গ্রাফ ফুঁড়ে সিলিঙের চটা খসাচ্ছে? না। মানুষের সময় নেই কারণ সে মোবাইলে চড়াইপাখির ছবি তুলছে, অফিস গিয়ে কম্পিউটারে প্লেন চালাচ্ছে, বাড়ি ফিরে পর্ন সাইট সার্ফ করছে, ইউটিউবে দেব আনন্দের গান দেখছে, টুইটারে মনের বুদ্বুদ রিলিজ করছে, ফেসবুকে অন্যের জন্মদিনের চমচম লাইক করছে, হোয়াট্সঅ্যাপে লিখছে এক্ষুনি বাথরুম যাচ্ছি। মানুষ কাজে নয়, অকাজে মজছে। তাই তার মনোযোগ এমন কুঁচকে যাচ্ছে, সারা দিন ব্রেন এতটুক ব্যায়াম না পেয়ে এমন হজমি-সাইজ পাচ্ছে, কিছুতেই তার পক্ষে আর ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়ে ফেলা সম্ভব নয়। মানে, যদ্দিন না ১৪১ ক্যারেক্টারের মধ্যে অনুবাদ বেরিয়ে যাচ্ছে। তা হলে, ক্রিকেটের কী হবে? টেস্ট তো উঠেই গেছে, ছেড়ে দিলাম, ওয়ান-ডে’র? আমি বুঝলাম, ও পঞ্চাশ ওভারও বসে বসে আর দেখতে পারবে না দেড়-সেকেন্ড অ্যাটেনশন স্প্যান’ওলা পোকামাকড়গুলো। এদের অভ্যাস চটজলদি চটপটা। চুলবুলে ইমলি। হুজুগে হুংকার। অগভীর অগািম। এদের তুড়ুক নাচাতে গেলে, ক্রিকেটকেও এইখানে নামিয়ে এনে, সেটাকে সুপার-ধমাকায় মুড়ে দিতে হবে।
জানি, আইসিএল-এর কথা উঠবে। ঠিকই, জি-নেটওয়ার্কের দৌলতে ২০০৭ থেকে ২০০৯ এই জিনিসই ভারতে ঘটেছে। কিন্তু বাওয়া, টিকতে তো পারেনি। প্রথম যে আদিম লোকটা গুহার দেওয়ালে থ্যাবড়া হরিণ এঁকেছিল তার ক্যালি যতই হোক, পিকাসোর নাম বেশি হবেই। আসল কথা শুরু করা নয়, আসল কথা হল জমাটি শুরু করা। জিনিসটাকে ফ্যাশনে এনে ফেলা। সব বোর্ড-ফোর্ডকে বলেকয়ে, পুরো ব্যাপারটা আইনি আর মেনস্ট্রিম ঢাল বেয়ে গড়িয়ে দিয়ে, ডঙ্কায় ঘা মারলাম। আর দেখতে হবে না, হুউশ তুবড়ি প্লাস ঘনচক্কর। দেশের যতগুলো চোখ, মন, জিভ, আর আমোদগেঁড়ে কলজে, সব্বাই চুবে গেল। আর এখন তো ক্রিকেট দেখা, খেলা, বোঝার গোটা অ্যাটিটিউডকেই ডিগবাজি খাইয়ে দিয়েছে এই একটা টুর্নামেন্ট। আস্কিং রেট বাইশ হলেও কেউ আর ভয় পায় না। পৃথিবী সেরা বোলারকেও টেল-এন্ডাররা কড়াং কড়াং করে ছয় হাঁকায়। একেবারে শীর্ষাসন করিয়ে দিলাম উইজডেনের শাস্তরকে। কানে ধরে বললাম, বাপ, মারার সময় ব্যাটসম্যানের মাথা কোথায় পা কোথায় পাছা কোথায় তা নিয়ে আর ভাবিসনে, একমাত্তর দেখার বিষয়, বল কোথায়। সেটা যদি বাউন্ডারির বাইরে হয়, হুররে। বাকি সব দূর্রে।
যুগপুরুষের সঙ্গে বেইমানি ইতিহাসের একটা শখ। আমি নাকি টাকা নিয়েছি, হ্যান করেছি, ত্যান করেছি। নিয়েছি তো নিয়েছি। আমার বৈপ্লবিক দর্শনের একটা পারিশ্রমিক নেই? পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার একটা ফি নেই? তবে প্যাঁচ কষে আমায় কিস্যু করা যাবে না। ঘুরছি-ফিরছি, প্যারিস হিলটনের সঙ্গে ছবি তুলছি, আর এক একটা টুকটাক টুইটে কাঁদিয়ে ছাড়ছি শাসক দলের রাজনীতিওলাদের। আমার পদবি-তুতো ভাইটি সিংহাসনে বসে বোমকে বোবা! রাষ্ট্রপতিকে অবধি ছাড়ছি না। রোজ একটা বোম ফাটাব, আর নারদ-নারদ লেগে অস্থির!
ওরে, আমি তো সোজা নয়, বসুন্ধরা রাজে-র টেবিলে পা তুলে বসে গপ্প মেরেছি। এমন অবাস্তব টাকা প্রফিট করেছি যে বিদেশি ম্যাগাজিন অবধি প্রশংসা লিখে কালি ফুরিয়ে ফেলেছে। জনতা নিজে বোঝার আগে আমি নাড়ি টিপে বলে দেব ওদের ফিউচার ফ্যান্টাসি। টি-টোয়েন্টি’র মোচ্ছবে তোরা পেগ মাপছিস, হয়তো আমি ক’দিনের মধ্যে লাগিয়ে দেব টি-টেন। বা টি-ফাইভ। টি-আড়াই! মাছি তখন নয়া রসগোল্লার পানে হুহু, আর তোরা কপাল চাপড়ে বলছিস, আইব্বাপ, এ বান্দা তো খেলতে নামে না, খেলার জন্ম দেয়!
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়