পাশে আছি তার্কিক ভারতের

ব ন্ধু বিপদে পড়লে বন্ধু তো পাশে থাকেই। সে কথা চিৎকার করে বলতে নেই। বললে অশ্লীল শোনায়। তবু আজ বলছি। এই ক’দিনে ক্লিশে হয়ে যাওয়া কথাটা চিৎকার করেই বলছি, পাশে আছি শ্রীজাত।

Advertisement

অংশুমান কর

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

ব ন্ধু বিপদে পড়লে বন্ধু তো পাশে থাকেই। সে কথা চিৎকার করে বলতে নেই। বললে অশ্লীল শোনায়। তবু আজ বলছি। এই ক’দিনে ক্লিশে হয়ে যাওয়া কথাটা চিৎকার করেই বলছি, পাশে আছি শ্রীজাত।

Advertisement

একটি কবিতা লিখেছেন শ্রীজাত। কবিতাটি কিছু মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছে। দাবি করা হয়েছে এমনটাই। এই ক’দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে এসেছে বেশ কিছু কথা। শ্রীজাতর পক্ষে, বিপক্ষে। সব কথাকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার কারণ নেই। যেমন যাঁরা বলছেন শ্রীজাত মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেননি, তাঁরা ওঁর ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ পড়েননি। কী আর করার! যাঁরা বলছেন, যে হুংকারকে কেন্দ্রে রেখে নির্মিত হয়েছে শ্রীজাতর কবিতা, সেই হুংকার যোগী আদিত্যনাথের নয়, তাঁদেরও বিনীতভাবে বলাই যায় যে, কবিতাটি তো সেই অর্থে এক ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা নয়, লেখা একটি মানসিকতার বিরুদ্ধে। এই কথা তাঁরা অবশ্য মানবেন না, হয়তো শুনবেনও না। যেমন যে দুটো শব্দ নিয়ে এত কথা হল, সেই দুটো শব্দ যে আসলে প্রতীক, বলতে চাইছে অন্য কিছু, ক্ষমতার প্রতাপের সামনে নির্মাণ করতে চাইছে এক বাঁশের কেল্লা, সেটাই বা শুনছে কে? শব্দের স্থূল অর্থে আটকে থাকেন যাঁরা তাঁরা তো কবিতাটি নিয়ে রণংদেহি হয়ে উঠবেনই। অস্বাভাবিক ঠেকছে অন্য একটি জিনিস। যাঁরা নিয়মিত কবিতা পড়েন তাঁরা, এমনকী যাঁরা কবিতা লেখেন আমার এমন অনেক বন্ধুও, স্পষ্ট করে বা ইঙ্গিতে বলেছেন যে, শ্রীজাতর এমন একটি কবিতা লেখা উচিত হয়নি, বিতর্কিত ইমেজটি এই কবিতায় না ব্যবহৃত হলেই ভাল হত।

আমি যদি এই বিষয়টি নিয়ে কোনও কবিতা লিখতাম, হয়তো আমার কবিতায় এই ইমেজটি আসত না। কিন্তু তার মানে কি এই যে, আর কারও কবিতাতেই ইমেজটি আসবে না বা আসা অনুচিত? এটাও মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে, এটির চেয়ে অনেক ভাল প্রতিবাদের কবিতা শ্রীজাত অতীতে লিখেছেন কোনও ‘বিতর্কিত’ শব্দ বা ইমেজ ব্যবহার না করেই। কিন্তু, এর পরেও, আমার বন্ধুদের একটি গোড়ার কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। একটি লেখা যখন এক জন কবির কাছে আসে, ধরা দেয়, তখন কবির কতখানি নিয়ন্ত্রণ থাকে সেই লিখন প্রক্রিয়াটির ওপরে? কবিতা রচনার সময় যখন বাঁধভাঙা বন্যার জলের মতো কবির দিকে ছুটে আসতে থাকে ইমেজের পর ইমেজ, তখন কি তিনি ভাববেন যে, এই ইমেজটি পলিটিকালি কারেক্ট হবে না, তাই কবিতাটিতে অব্যবহার্য? এও তো এক ধরনের ছক! না কি কবিতাটি লেখা হয়ে যাওয়ার পরে তিনি ভাববেন সেই লেখাটির জনমানসে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তার পর সিদ্ধান্ত নেবেন কবিতাটি প্রকাশ করবেন কি না? এই ধরনের যুক্তি কি আসলে কবির স্বাধীনতাকেই খর্ব করে না? এ তো বাইরের পুলিশের ভয়ে অন্দরের দারোয়ানগিরি। নিজের প্রয়োজনের বাইরে আর কোনও প্রয়োজনের কাছেই কি নতজানু হবে কবিতা?

Advertisement

কেন জানি না মনে হচ্ছে, আমার বন্ধুদের অনেকেই অশনিসঙ্কেতটি দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁরা কি মন দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রীজাতর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত শব্দগুলিকে পরীক্ষা করেছেন? হতে পারে যে, কবিতাটি সত্যিই কারও কারও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে। তাঁরা তো এ জন্য তাঁদের বিরুদ্ধমত (কখনও কখনও রুচি ও ভব্যতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে) প্রকাশ করেছেন। কিন্তু, এখানেই না থেমে থেকে যখন কেউ একটি কবিতার বিরুদ্ধে পুলিশে যায়, যখন এক জন কবির বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য ধারায় মামলা করা হয়, তার পেছনের পরিকল্পনা ও রাজনীতিটি কি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে না? কেবল ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে, এই যুক্তিতেই একটি কবিতা লেখার জন্য কবিকে জেলে পোরার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে? যে পোস্টগুলো শ্রীজাতর বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে তার অনেকগুলি থেকেই এটা স্পষ্ট যে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাম্প্রতিক জয়কে শ্রীজাত মান্যতা দিচ্ছেন না, এটাই তাঁদের অসূয়ার আসল কারণ। অর্থাৎ ভোটে জিতে গেলে, তখ্‌তে যিনি বসবেন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে হতেই হবে সংখ্যালঘুর মত। গণতন্ত্র কি এই একপেশে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে প্রশ্রয় দেবে? কবিরা দেবেন? দিলে, তাঁরা কি নিশ্চিত, যে বজ্র ঈশানকোণে আজ গর্জে উঠেছে শ্রীজাতর মাথায় পড়বে বলে, তা ভবিষ্যতে তাঁদেরও আঘাত করবে না?

সে পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে যখন, আমরা যারা কবিতা লেখার কাজে রত তাদের শ্রীজাতর কবিতাটি নিয়ে কূটতর্কে না মেতে, ব্যক্তিগত অভিমান ও ভুল বোঝাবুঝির অতীতকে অতিক্রম করে, বর্তমানের দাবিতে শ্রীজাতর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাই, আমি বলছি, চিৎকার করে বলছি যে, শ্রীজাতর পাশে আছি। এ কেবল আমার বন্ধুর পাশে থাকা নয়। বাক্‌স্বাধীনতার পাশে থাকা। গণতন্ত্রের পাশে থাকা। ধর্মনিরপেক্ষতার পাশে থাকা। তার্কিক ভারতের পাশে থাকা।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন