যাওয়া-আসার পথে পথে

আসানসোলের সঙ্গে গাঁধীজির প্রথম পরিচয় অবশ্য সুখের হয়নি। বিশ্রামের জন্য তিনি কিছুক্ষণ আসানসোল স্টেশনে নেমেছিলেন। কিন্তু এই স্টেশনের বিশ্রামাগারের চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং অপরিচ্ছন্নতা দেখে তিনি ব্যথিত এবং ক্রুদ্ধ হন। লিখছেন বিশ্বনাথ মিত্রআসানসোলের সঙ্গে গাঁধীজির প্রথম পরিচয় অবশ্য সুখের হয়নি। বিশ্রামের জন্য তিনি কিছুক্ষণ আসানসোল স্টেশনে নেমেছিলেন। কিন্তু এই স্টেশনের বিশ্রামাগারের চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং অপরিচ্ছন্নতা দেখে তিনি ব্যথিত এবং ক্রুদ্ধ হন। লিখছেন বিশ্বনাথ মিত্র

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:০৫
Share:

রেলের কামরায় মহাত্মা গাঁধী। ফাইল ছবি

উনবিংশ শতকের শেষ লগ্নে আসানসোলের সঙ্গে উত্তর ভারতের সরাসরি রেল সংযোগ তৈরি হল। কয়লার শহর আসানসোলের সঙ্গে সারা ভারতের যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলে গেল। একই সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা ওঠাপড়ার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল আসানসোলও। সেই সূত্রেই এখানে এসেছিলেন জাতির জনক মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী।

Advertisement

ভারত জুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে গাঁধীজিকে যাতায়াত করতে হত। আর যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল রেল। সেই রেলেই গাঁধীর প্রথম আসানসোলে আসা। আসানসোলের সঙ্গে গাঁধীজির এই প্রথম পরিচয় অবশ্য সুখের হয়নি। বিশ্রামের জন্য তিনি কিছুক্ষণ আসানসোল স্টেশনে নেমেছিলেন। কিন্তু এই স্টেশনের বিশ্রামাগারের চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং অপরিচ্ছন্নতা দেখে তিনি ব্যথিত এবং ক্রুদ্ধ হন। এই বিশ্রামাগারে তখন পানীয় জল, বসবার বেঞ্চ, এমনকি, শৌচাগার— কোনও কিছুরই ব্যবস্থা ছিল না।

রেলে যাতায়াত করলে সাধারণত তৃতীয় শ্রেণির কামরাই পছন্দ করতেন গাঁধীজি। কারণ, এই কামরায় ভারতের শোষিত জনগণের প্রকৃত স্বরূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। তখন, তৃতীয় শ্রেণির কামরায় যাতায়াত ছিল অভাবনীয় দুর্ভোগের। গাদাগাদি করে যাত্রীরা এই তৃতীয় শ্রেণির কামরায় যাতায়াত করতে বাধ্য হতেন। এই প্রেক্ষাপটেই অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা পর্বে এই আসানসোল রেল স্টেশনেই গাঁধীজির সঙ্গে ঘটে যায় এক অপ্রীতিকর ঘটনা। পুণে যাওয়ার জন্যে বর্ধমান স্টেশনে তিনি অতি কষ্টে তৃতীয় শ্রেণির জন্য টিকিট কাটেন। কিন্তু ট্রেনের প্রতিটি তৃতীয় শ্রেণির কামরা এত ভিড়ে ঠাসা ছিল, তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল স্ত্রীকে নিয়ে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে প্রবেশ করা। বাধ্য হয়ে তিনি উচ্চতর শ্রেণির ইন্টার ক্লাস কামরায় উঠতে বাধ্য হন। কারণ, তাঁকে গন্তব্যে পৌঁছতেই হত। ঘটনাটি গার্ডের নজরে পড়ে যাওয়ায় গার্ড তাঁকে আসানসোল স্টেশনে বাড়তি ভাড়া জরিমানা করেন। গাঁধীজি এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ গার্ড তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি।

Advertisement

১৯২৫ সালের ১২ এবং ১৩ সেপ্টেম্বর ষোড়শ বিহার সম্মেলন উপলক্ষে মহাত্মা গাঁধী আসানসোলের কাছেই পুরুলিয়ায় সাত দিন কাটিয়ে যান। এর পরে দ্বিতীয় পর্বের আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন গাঁধীজি আবার পুরুলিয়ায় আসেন। হরিজনদের স্বার্থরক্ষায় ১৯৩৪ সালের ২৯ মে সেখানে এক জনসভায় ভাষণ দিলেন। আর আসানসোলের আর এক প্রতিবেশী শহর বর্ধমানে তিনি এসেছিলেন ১৯২৫ সালে। বংশগোপাল টাউন হল ময়দানে বিশাল এক জনসভায় চরকা কেটে জনগণকে স্বদেশীয়ানায় উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন।

এ দিকে আসানসোলেও সত্যাগ্রহ এবং অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল। গাঁধীজির আহ্বানে ১৯২১ সালে এখানে গড়ে উঠল কংগ্রেস সমিতি। আসানসোল শহরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন গাঁধীজির শিষ্য এবং স্নেহধন্য বিজয় পাল। ১৯৩৮ সালে গাঁধীজির হস্তক্ষেপে দীর্ঘমেয়াদি বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান আসানসোলে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের অন্যতম নেতা বিনয় চৌধুরী ও আরও কয়েক জন।

এক দিন যে আসানসোল রেল স্টেশনে গাঁধীজি ইংরেজ গার্ডের অভব্যতার শিকার হন, চল্লিশ দশকের গোড়ায় সেই ক্ষতে খানিক প্রলেপ দেন আসানসোল গ্রামের বাসিন্দা নেপাল রায় ও তাঁর কয়েক জন সঙ্গী। ইন্ডিয়ান টেরিটোরিয়াল আর্মির তরুণ সদস্য এবং রেলের ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন বিভাগের কর্মী নেপাল রায় কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে আসানসোল স্টেশনের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে ট্রেনের ভিতরই গাঁধীজিকে স্যালুট জানিয়েছিলেন।

সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা ঘটল ১৯৪৬ সালে। ওই বছরের মাঝামাঝি গাঁধীজি রানিগঞ্জ স্টেশনে নামেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণির সংরক্ষিত কামরায় কলকাতা যাচ্ছিলেন। সহযাত্রীরা ছাড়াও গাঁধীজির সঙ্গে একটি পোষ্য ছাগল ছিল। সে দিন গাঁধীজিকে দেখতে স্টেশনে প্রচুর ভিড় হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের কড়া নির্দেশ ছিল, ট্রেন যেন বেশিক্ষণ রানিগঞ্জ স্টেশনে না দাঁড়ায়। কিন্তু ব্রিটিশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গাঁধীজিকে সংবর্ধনা এবং জনসেবার জন্য তোলা চাঁদা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রানিগঞ্জের প্রাক্তন পৌরপিতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী চিকিৎসক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ। এই রানিগঞ্জেরই সরস্বতীদেবী খেতান সবরমতী আশ্রমে গান্ধীজির অন্যতম শিষ্যা ছিলেন।

গাঁধীজির সঙ্গে আসানসোল উষাগ্রাম মিশনারি স্কুলের সংযোগ অত্যন্ত নিবিড় ছিল। এই স্কুলের তৎকালীন রেভারেন্ড ফায়েড জি উইলিয়াম এবং তাঁর স্ত্রী উদ্ভাবন করেন অল্প খরচে সেপটিক ট্যাঙ্ক তৈরির পদ্ধতি। গাঁধীজির নির্দেশে তাঁর একান্ত সচিব দু’বার এই ‘রুরাল হোম স্যানিটেশান’ প্রত্যক্ষ করতে এবং শিক্ষা নিতে এই স্কুলে আসেন। ১৯৩৫ সালে গান্ধীজির সেবাগ্রাম আশ্রমে উষাগ্রামের সেপটিক ট্যাঙ্ক মডেল স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেখানে প্রযুক্তিগত ত্রুটি দেখা দেওয়ায় ১৯৪১ সালের অগস্টে গান্ধীজি রেভারেন্ড উইলিয়ামকে চিঠি লেখেন, যাতে তাঁরা সস্ত্রীক সেবাগ্রামে এসে এ বিষয়ে পরামর্শ দেন।

সূত্র: ১) থার্ড ক্লাস ইন ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ: মহাত্মা গাঁধী, ২) মহাত্মা গাঁধী; হিজ লাইফ, রাইটিংস অ্যান্ড স্পিচেস: সরোজিনী নাইডু, ৩) অগ্নিযুগের রাণীগঞ্জ: গোপাল নন্দা, ৪) আসানসোলের ইতিহাস: জগন্নাথ সামন্ত, ৫) আসানসোল পরিক্রমা: শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ৬) মানভূমের স্বাধীনতা আন্দোলন: দিলীপকুমার গোস্বামী, ৭) বর্ধমানের ইতিহাস সন্ধান: গিরিধারী সরকার এবং জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য।

ইস্টার্ন রেলওয়ে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন