প্রবন্ধ ২

মানুষ পরে, আগে কাজ

এটাই কি ইতিহাসে প্ল্যাটিনাম দিয়ে লিখে দিল না: কেডা জন্ম, কেডা মৃত্যু, কেডা বিরহজ্বালা, সুইসাইডকে সাইডে রেখে ‘কর্ম’ জিংগালালা!দেশটা গেল কীসে? কাজ না করে। কেউ কোনও কাজ করে না, শুধু ফাঁকির ফিকির খোঁজে। আমার স্যর মাথাব্যথা করছিল। কুকুর তেড়ে আসছিল। প্রেমের কথা মনে পড়ছিল আর মিচিক মিচিক কান্না পাচ্ছিল। আরে! এগুলোকে এড়িয়ে পেরিয়ে তোমার মনটাকে কাজে জুতে দিতে হবে, বেসিক শিক্ষেটা নেই? কিন্তু পৃথিবীর আশ্চর্য নিয়ম, যদা যদা হি ধর্ম গ্লানিগ্রস্ত হয়, এক পিস জ্যোতির্ময় পাবলিক ঠিইক উপস্থিত হন, ঘেঁটি ধরে নেড়ে দেন গেধো নরকুলের, এবং সবাই দনাদ্দন সবক শিখে বলে, ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের সাথে!

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০০:২১
Share:

দেশটা গেল কীসে? কাজ না করে। কেউ কোনও কাজ করে না, শুধু ফাঁকির ফিকির খোঁজে। আমার স্যর মাথাব্যথা করছিল। কুকুর তেড়ে আসছিল। প্রেমের কথা মনে পড়ছিল আর মিচিক মিচিক কান্না পাচ্ছিল। আরে! এগুলোকে এড়িয়ে পেরিয়ে তোমার মনটাকে কাজে জুতে দিতে হবে, বেসিক শিক্ষেটা নেই? কিন্তু পৃথিবীর আশ্চর্য নিয়ম, যদা যদা হি ধর্ম গ্লানিগ্রস্ত হয়, এক পিস জ্যোতির্ময় পাবলিক ঠিইক উপস্থিত হন, ঘেঁটি ধরে নেড়ে দেন গেধো নরকুলের, এবং সবাই দনাদ্দন সবক শিখে বলে, ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের সাথে! নইলে ভারত ভেসে যেত, ডুবে যেত, ইয়েলো সাবমেরিন দিয়ে টেনেও তারে পারে তোলা যেত না! এই মুহূর্তে, এই অলস অকর্মা অলবড্ডে ভূখণ্ডে অবতার রূপে অবতীর্ণ হল কে? এই আমি। আআআমি! মুখে বলি ‘আপ’, কিন্তু আসলে বলতে চাই ‘হম’, ‘অহম্’, ‘সোহম্’। মানে, সে-ই আমি, আপনিই আমি, আমিই আপনি, আমি না থাকলে আপনার আবার দর কী? দুধ না থাকলে একলা ভাসবে সর কি?

Advertisement

এ বার কোনও গবেট জিজ্ঞেস করতে পারে, ভগবন্, আপুনি যে এই জঞ্জালের ডাঁইয়ে চরণ রাখলেন, তা কোন আইটেমটা প্রচারার্থে? উত্তর হল, কর্মসংস্কৃতি। কাজ করা। করে যাওয়া। কেমনে এই ফান্ডা পৃথিবীর স্ক্রিনে ক্লোজ-আপে প্রেজেন্ট করলেম? বাবা, জানিস নে? লোকটা গাছে গলায় দড়ি দিয়ে সব্বার সামনে ঝুলে পড়ে, মরে গেল। আমার সভা তখন চলছে। অন্য নশ্বর হলে কী করত? প্রম্প‌্টলি মুচ্ছো যেত! ‘হায় রে, মিটিং পণ্ড হল’ বলে রোলারুলি করত। কিংবা চোখটোখ কপালে তুলে, হাঁ হাঁ করে ছুটে গিয়ে, বডি চ্যাংদোলা করে হাসপাতাল দৌড়ে, চেঁচিয়ে গলা-ফলা ঘসঘসিয়ে, একসা হিস্টিরিয়া। কোথায় থাকত তার সভার কাজ, কোথায় ডিসিপ্লিন। আমি কী করলাম? উফ, বলতেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এই নাটুকে ভারতবর্ষে যা কেউ কখনও করেনি, তা-ই অনায়াসে করে অ্যায়সা স্বাক্ষর রাখলাম, মকশো করার ধক সংগ্রহ করতেও শতাব্দী কেটে যাবে। আমি, সিম্পলি, যে কাজটা করতে এসেছিলাম, সেটা চালিয়ে গেলাম। সভা করলাম। স্পিচ দিলাম। পুরো সভা শেষ হলে, ধীরেসুস্থে হাসপাতালে গেলাম লোকটার খবর নিতে। এই ঠান্ডা-মাথা কর্মক্রমটাই কি, এই লাইন অব অ্যাকশনটাই কি, ইতিহাসে প্ল্যাটিনাম-ফ্যাটিনাম দিয়ে লিখে দিল না: কেডা জন্ম, কেডা মৃত্যু, কেডা বিরহজ্বালা, সুইসাইডকে সাইডে রেখে ‘কর্ম’ জিংগালালা!

বুড়বকরা আমাকে অমানবিক বলছে। একটা মানুষের প্রাণ চলে গেল, আর আমি কিনা তা-ও বক্তিমের দিকে ঢলে পড়লাম! কেউ কেউ তো প্রেসক্রিপশন দিয়েছে, আমার নাকি গাছে উঠে গিয়ে লোকটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করা উচিত ছিল! অ্যাঁ! দিব্যি ভব্যিযুক্ত হয়ে স্টেজে বসে আছি, লেকচারটা আউড়ে নিচ্ছি মনে মনে, কোনখানগুলোয় হাততালি পাওয়া যাবে সেই হিসেব ইস্ক্রুপ দিয়ে এঁটে নিচ্ছি চটাপট, হেনকালে কে কোথায় লাফঝাঁপিয়ে ড্রামা করতে লাগল আর আমি তার ন্যাজে ন্যাজে হুপুই খেয়ে তড়বড়িয়ে গাছে চড়ে পড়ব! তখন তোরাই আবার বাঁদর বলে আমার কার্টুন আঁকবি নে? বলবি নে, এই দ্যাখো, এ ব্যাটা যেমন নাচাবে তেমনি নাচবে? তার চেয়ে বড় কথা, পড়ে গেলে কে দেখবে? পরের সভায় কি তুই আমার ক্রাচ বয়ে দিবি? আরে ভাই, আমি ছটফট করি না, স্থিতপ্রজ্ঞ টাইপ। আমি ঘটনায় গতর লাগিয়ে অংশ নেব কেন? মজুর না কি? বরং বাইরে দাঁইড়ে ঘটনাকে বিশ্লেষণ করব। তার নির্যাস বের করে, নীতিকথাটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেব। সেটাই কি প্রকৃত দ্রষ্টার পারপাস নয়?

Advertisement

হ্যাঁ, জিভ-ফিভ বের করে সবার সামনে মরে গেল, ব্যাপারটা হরেন্ডাস। কিন্তু বৎস, আমার কারবার তো একটামাত্তর ট্র্যাজেডিকে নিয়ে নয়। আমার দূর-নজর তো চলে গেছে আসমুদ্রহিমাচল পিলপিলে হতভাগ্যদের দিকে, কোটি কোটি চাষিভাইয়ের দিকে, সমগ্র কৃষিক্ষেত্রের সতেরো হাজার নিটিরপিটিরের দিকে। আমার মতো লোকেরা যখন কথা বলে, নির্দিষ্ট কারও দিকে তাকিয়ে বলে না। হিস্ট্রির দিকে তাকায়। যখন কাজ করে, আজকের কথা ভেবে করে না। ষোলো বছর বাদে যে ডিসেম্বর মাসে বিপ্লব হবে, তার ভিত্তি-পাটকেল পোঁতে। ওই ওই একটা লোক মরে যাচ্ছে মরে গেল রে বলে আদিখ্যেতা যারা করে, তারা শুধু সামনের ইভেন্টটা দেখতে পায়, আর আমি তৎক্ষণাৎ দেখতে পেয়ে যাই পেছনের সত্যটা। যে যন্ত্রণা থেকে, যে সমস্যা থেকে লোকটা আত্মহত্যা করল, তার সমাধান লোকটাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলে হবে না। একটা দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হবে। কেন হবে, আর কী-ই বা হবে সেই সংগ্রামের প্রণালী, এটা পাবি আমার বক্তৃতায়। আর তোদের হড়বড়েপনায় পাবি, শুধুমাত্র যা প্রকট প্রত্যক্ষ, তাকে দেখার, ও সেইটুকুই দেখার, তাকে পেরিয়ে আর কিছুই না দেখতে শেখার ছব্বা।

শোন, বডি নিয়ে রাজনীতি করতে অনেকেই পারে। লোকটার সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে, তার পর ওর বডি সৎকার করে, না না, দাঁড়া, সৎকারের আগে মৃতদেহ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে অবস্থান করে, নারা তুলে, লঙ্কাকাণ্ড করতে কি আমি পারতাম না? কী বললি? আমার তখন এগুলো মনে পড়েনি? কারণ আমি রাজনীতির ময়দানে দুধুভাতু? ওতেই বরং আমার একশো বক্তৃতার কাজ হত? বল, বলে যা। আসল কথা, গিমিকবাজিকে আমি ওয়াক-ওভার দিই। হ্যাঁ, ক্ষমা একটা চেেয় নিয়েছি, আমার টিমের একটা লোক তো টিভিতে ফ্যাঁচ করে কেঁদেও দিয়েছে। কিন্তু ওগুলো বাইরের ভ্যানতাড়া। আসলে আমরা বডি নিয়ে কাজ করি না, আত্মা নিয়ে করি। একটা বডি ডেড হয়েছে, কিন্তু দেশের আত্মাকে প্রকৃত কাজে লেলিয়ে দিতে পারলে সহস্র বডি জেগে উঠবে। তারা যখন আমার হয়ে স্লোগানাবে, তোদের নাস্তিক কান ঢাকা দিতে মাফলার পাবি কোথা?

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন