প্রবন্ধ ৩

ছবিটা সে কালের, আবার এ কালেরও

সত্যজিত্‌ রায়, মৃণাল সেন থেকে অকস্মাত্‌ তিনি ধুলো-কাদায় নেমে তুলে আনেন রান্দিয়া সোরেন, হরিপদ দলুই, চিনিবালা দাসীদের।অর্থনীতির ওঠা-পড়া, বিশ্ব রাজনীতির বাঁক-মোড়, আখতারি বাইয়ের গান, সত্যজিত্‌ রায়, মৃণাল সেনের সিনেমা, নির্মলকুমার বসুর বিদ্যাচর্চা থেকে শুরু করে অক্লেশে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জ্ঞানের দীপ্তি ছড়িয়ে যেতে যেতে অকস্মাত্‌ তিনি রাস্তার ধুলো-কাদায় নেমে তুলে আনেন পুরুলিয়া-হুগলি-কোচবিহারের রান্দিয়া সোরেন, হরিপদ দলুই, চিনিবালা দাসীর মতো মানব-মানবীদের।

Advertisement

তোয়া বাগচী

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৫ ০০:০০
Share:

অর্থনীতির ওঠা-পড়া, বিশ্ব রাজনীতির বাঁক-মোড়, আখতারি বাইয়ের গান, সত্যজিত্‌ রায়, মৃণাল সেনের সিনেমা, নির্মলকুমার বসুর বিদ্যাচর্চা থেকে শুরু করে অক্লেশে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে জ্ঞানের দীপ্তি ছড়িয়ে যেতে যেতে অকস্মাত্‌ তিনি রাস্তার ধুলো-কাদায় নেমে তুলে আনেন পুরুলিয়া-হুগলি-কোচবিহারের রান্দিয়া সোরেন, হরিপদ দলুই, চিনিবালা দাসীর মতো মানব-মানবীদের। বুদ্ধির ছটা অনেকেরই থাকে, জ্ঞানবানেরও অভাব নেই, কিন্তু জ্ঞান ও বুদ্ধির উপরে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি পরম মমতা যাঁদের বিশিষ্ট করে তোলে, তেমন স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল লেখক স্বাভাবিক ভাবেই কম। এই কারণেই অশোক মিত্র অশোক মিত্র: ভিড়ে মিশে থাকা রক্তমাংসের মানুষ, আবার নিজস্ব প্রজ্ঞায় দ্যুতিমান।

Advertisement

উনিশ শতকের নবজাগরণ বিংশ শতাব্দীর বঙ্গসমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় উচ্চবর্ণ/বর্গের আধিপত্যের ভিত পোক্ত ভাবে গড়ে দেয়, আবার তার বিরুদ্ধে বহমান এক স্রোতেরও জন্ম দেয়। সে ধারা মার্ক্সবাদী বুদ্ধিচর্চায় ঋদ্ধ এক সমাজবোধ, যা সংস্কৃতি, রাজনীতিকে এক গতিশীল অনন্যতার দিকে নিয়ে যায়। মুদ্রিত চিন্তাচর্চাই ছিল এই সময়ের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেই অতীতের অদ্ভুত ছটায় মুগ্ধ হয়ে যাই অশোক মিত্রের ক্যালকাটা ডায়েরি পড়তে পড়তে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে নানা ঘটনা নিয়ে ৪৬টি প্রবন্ধের সংকলন। বেশির ভাগই প্রকাশিত হয়েছিল ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’তে। বইটি বিলেত থেকে প্রকাশিত হওয়ার (১৯৭৭) অনেক বছর পরে আমার পৃথিবীর আলো দেখা। কিন্তু, ২০১৪-তে পুনঃপ্রকাশিত এ বইয়ের হাত ধরে সমকালে যেন অতীতের আলোক দর্শন করলাম। শুধু ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, তার বাইরেও সে দিনের অবস্থার একটি চিত্রণ এই বই। আবার তার পাতায় পাতায় খুঁজে পাই বর্তমানের ছায়া-ছবি।

বই শুরু হয় কলকাতার একটি দিন নিয়ে। ‘ঘাম, ঘামের গন্ধ। ঝরঝরে সিএসটিসি-র বাসের কালো ধোঁয়া..., মাছ, সজীব গন্ধে একাকার বাজার...’ (পৃ ৩) ১৯৬৯ সালের কলকাতার একটি দিন। ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েও দেখি সেই ধুলো, বালি, দারিদ্র। অন্য দিকে ক্যালকাটা ক্লাব বা বাজারের অমোঘ আমন্ত্রণ, শপিং মল বা মাল্টিপ্লেক্সের পূর্বাশ্রম।

Advertisement

’৭২ থেকে ’৭৫ সালের মধ্যে লেখা প্রবন্ধগুলি সে সময়কার দেশ তথা রাজ্যের এক পরিষ্কার চিত্র দেয়। জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও তার পরবর্তী নৃশংসতার বর্ণনা পড়তে গিয়ে শিউরে উঠতে হয়। সদানন্দ রায়চৌধুরীর দুই ছেলে প্রবীর ও প্রদীপ, দুজনেই কৃতী ছাত্র। সামান্য কেরানির মাইনে বৃদ্ধির তাগিদে আগে যদিও বা ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে আলোচনার স্বাধীনতা ছিল, ফ্যাসিবাদী সরকার সেটুকুও কেড়ে নিয়েছিল। চিরকাল মুখ বুজে কেরানির কাজ করে যাওয়া সদানন্দবাবুর ছেলে দুটি চুপ থাকতে পারল না। এক জন শিবপুরের ছাত্র, অন্য জন প্রেসিডেন্সির। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রকারান্তরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ল। পরিণাম? ‘প্রদীপ, বড় ভাইটির পুলিশি তত্ত্বাবধানে থাকাকালীনই রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। কিছু দিন ধরেই তাকে রাজ্য পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ক্রমাগত জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছিল। এরই মধ্যে খবর অনুযায়ী, সাংঘাতিক আভ্যন্তরীণ রক্ত ক্ষরণের দরুন তার মৃত্যু হয়...বড় ছেলে মারা যাওয়ার পরও সদানন্দবাবু ও তার স্ত্রীর শেষ আশা দ্বিতীয় ছেলেটি তখনও বেঁচে।... ৩রা জুন শনিবার সকালে পালানোর চেষ্টায় বাধা দেওয়া সময়, শোনা যায়, হাওড়া ছেলের পাঁচ বন্দীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে আত্মরক্ষার তাগিদে।...প্রবীর রায় চৌধুরী তাঁদের একজন।’ (পৃ. ৬৮-৬৯)

ভারতে যা ঘটেছে, তা বহু পূর্বেই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছিল। ভাগচাষি ইন্দ্র লোহারকে উত্‌খাত করার জন্য জমি-মালিক ও প্রশাসনের কর্তাদের একজোট প্রয়াসের ছবি আজ খুব অপরিচিত ঠেকে না। দেশের বর্তমান সরকারও দেখা যাচ্ছে গরিব মানুষের সর্বজনীন উন্নতির সমস্ত ব্যবস্থাগুলিকে সরিয়ে রেেখ ‘চুঁইয়ে পড়া’ অর্থনীতিকেই অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছেন।

অপর একটি প্রবন্ধ ‘টেক আ গার্ল লাইক হার’-এ ১৯৪৭-৫০ সালের মধ্যে ও পার থেকে চলে আসা বিধ্বস্ত পরিবারগুলির বর্ণনাও পাই, যেখানে অত্যন্ত অল্প বয়সেই মেয়েদের মুখ বুজে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়। শিক্ষার্থী অবস্থাতেই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে। দাদারা বড় হয়ে কেউ বা কমিউনিস্ট দলে যোগ দিয়ে জেলে বন্দি, কেউ তখনও ময়দানে মিছিলে ব্যস্ত, আবার কেউ পালিয়ে বাঁচছে। মায়ের গয়না বেচে সংসার চলে। এত কিছু সামলে মেয়েটি কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যায়। শখ বলতে একটাই: স্কুলে পড়ানো। চাকরিও জুটে যায় একটা। কিন্তু স্কুল অনেক দূরে। সংসার সামলে, স্কুল করে তার জীবন চলতে থাকে। কেউ বিয়ের কথা বলে না। দিদির পয়সায় ভাই বা দাদাদের তা-ও এক-আধ বার চৌরঙ্গির রেস্তোরাঁয় খাওয়া পোষায়, দিদির স্কুলে টিফিনে শুধু একটা কলা। এমন হাজার হাজার মেয়ে, যাঁদের জীবন এমন নিস্তরঙ্গ, যাঁরা অভিযোগও করেন না, মুখ বুজে দিনের পর দিন কাটিয়ে চলেন, তাঁদের কথা বলেছেন অশোক মিত্র।

পৃথিবীর সব দেশে ধনী-দরিদ্রের বিভেদটা যে একই রকম, তা বার বার চোখে পড়ে যায় প্রবন্ধগুলিতে। তত্‌কালীন ব্রাজিলে (এখনও!) ভগবানের স্থানে যদি কাউকে বসানো হত তিনি ছিলেন ফুটবল সম্রাট পেলে। ব্রাজিলের অন্যান্য ‘নিগ্রো’ মানুষগুলির অবস্থার কিন্তু তাতে বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। বেশির ভাগেরই, আজও, নিজের জমি নেই, অন্যের জমিতে বা কারখানায় অপ্রশিক্ষিত শ্রমিক হিসেবে কাজ করে অত্যন্ত দারিদ্রে দিন গুজরান। ১৯৭৩ সালে লেখা প্রবন্ধের সঙ্গে ২০১৪ বিশ্বকাপের আয়োজক ব্রাজিলের কত মিল, যেখানে পেলে এই বৃহত্‌ গোষ্ঠীর মানুষ হয়েও আজ ক্ষমতাবান দলেরই প্রতিনিধি, দেশের ব্যাপক দারিদ্র তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়।

বার বার উঠে এসেছে ক্ষুধা প্রসঙ্গ। অজস্র উদাহরণের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাই তত্‌কালীন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুধার ব্যাপকতা। সন্তানকে তিন দিন খেতে দিতে না-পারার জ্বালায় বাবা তাকে পুকুরে ডুবিয়ে মারছে, বহু দিনের বন্ধু দুই দিনমজুর এক সপ্তাহ খেতে না পেয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নিহত হচ্ছেন। একই সময়ে, কংগ্রেসের কোনও নেতার ব্যক্তিগত জীবনের বিপুল স্বাচ্ছন্দ্য। প্রশাসক ও নীতিনির্ধারকদের কদর্যতা লেখাগুলির ছত্রে ছত্রে। (প্রবন্ধ ৩২, ৩৩, ৩৫, ৩৬)

প্রকাশকের মন্তব্য ছাড়াও সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখবন্ধ এবং ১৯৭৮ সালে এ বই নিয়ে লেখা ইতিহাসবিদ রণজিত্‌ গুহের পর্যালোচনা সংকলনে যুক্ত হয়েছে। লেখাগুলি পড়তে পড়তে বার বার উপলব্ধি করি, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সংগঠিত আন্দোলনেরই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

দ্য ক্যালকাটা ডায়েরি, অশোক মিত্র। প্রকাশক: পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন