প্রবন্ধ ২

সেই জন্যই মুকুলরা বিপজ্জনক

গত কাল বলছিলাম দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কী ভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে। এ বার আসি মুকুল মাঙ্গলিকের কথায়। মুকুল আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধু; আমরা (আমি এবং সুমিত সরকার) একটা বই ওকে উৎসর্গ করেছিলাম।

Advertisement

তনিকা সরকার

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

গত কাল বলছিলাম দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কী ভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে। এ বার আসি মুকুল মাঙ্গলিকের কথায়। মুকুল আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধু; আমরা (আমি এবং সুমিত সরকার) একটা বই ওকে উৎসর্গ করেছিলাম। মুকুলের মতো সৃষ্টিশীল, নতুন ভাবনা ভাবতে পারার মতো ইতিহাসের অধ্যাপক আর দেখিনি। ওর অধ্যাপনা অকল্পনীয়। রামজস-এর ছাত্রদের কোনও একটা বিষয় বোঝাবার আগে ও চেষ্টা করে তাদের সেই বিষয়ের সঙ্গে জড়িত কোনও একটি জায়গা দেখিয়ে আনত। তার পরে তার সম্পর্কে পাঠ; ‘ট্রাভেলিং এস এ পার্ট অফ হিস্ট্রি’। কত রকম ভাবে যে ছাত্রদের মনের দরজা জানলা খুলে দিতে পারে ও, ভাবতেও পারি না। সেইজন্যই বোধ হয় আজ ও এবিভিপির কাছে এতটা বিপজ্জনক। ওর কাছে পড়লে ছাত্ররা পৃথিবীটাকে খোলা মনে বিচার করতে শিখবে। ওর পড়ানোর বিষয়গুলিও সেই ভাবে বাছাই করা: জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, বিপ্লবী আন্দোলন। অসম্ভব ভাল ছাত্র, অথচ গবেষণাও করল না শুধু পড়াবে বলে। উচ্চাশা নেই: ইউনিভার্সিটির ছাত্র নয়, রিসার্চ স্কলার নয়, ও চায় শুধু সদ্য স্কুল থেকে আসা স্নাতক স্তরের ছাত্র। এদের অনেকে পরে ইউনিভার্সিটিতে যাবে, অনেকে হয়তো চাকরি করবে কিংবা জীবনে অন্য কাজকর্মে ছড়িয়ে পড়বে। ওদের মনটা তৈরি করে দেওয়া, ওদের কৌতূহল জাগিয়ে দেওয়া, এই ওর লক্ষ্য। ছাত্রদের নিয়ে বেড়াতে যাবে, ফিল্ম দেখাবে, গান শোনাবে; যাকে বলে তাদের মনের সার্বিক একটা মাজাঘষা করবে। এত বিনয়ী: ছাত্রদের সঙ্গে সব সময় নিজে শিখছে।

Advertisement

এই মানুষটা হিংসাত্মক স্লোগান দিয়েছে, এ অভিযোগ যে কত অবাস্তব, সেটা বোঝাতে একটা গল্প বলি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা। ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার সময় মুকুল একটা মোমবাতি মিছিল আয়োজন করল। বড় জমায়েত হল। আমরা আক্রান্তও হলাম। সুমিতের (সরকার) কলার ধরে ‘গদ্দারোঁ কো লাথ মারো’, আরও কত কী বলা হল। রামজস কলেজের ওপর থেকে ভাঙা বোতলের টুকরো ছোড়া হচ্ছিল। একটি মেয়ের হাত ভয়ানক জখম হল। সেই মুহূর্তে মুকুল এক বার ওদের ‘এটা তোমরা কী করছো’ বলে গলা তুলে বকল। তার পাঁচ মিনিট পর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল যে আমার ভুল হয়ে গেছে; আমি শিক্ষক, তোমরা ছাত্র, আমার মেজাজ হারানো ঠিক হয়নি। আমার তোমাদের বোঝানোর কথা, চিৎকার করে বকার কথা নয়। মুকুল এই রকম অধ্যাপক।

এরা কাকে আক্রমণ করছে? কার কণ্ঠরোধের চেষ্টা করছে? লক্ষণীয়, সোশ্যাল সাইন্সেস আর লিবারাল আর্টস-এর অধ্যাপকরাই বেশি আক্রান্ত। এই দুটো বিষয়ই আমাদের ভাবতে শেখায়, আলোচনা-সমালোচনা করতে শেখায়, নানা জগতের সঙ্গে পরিচয় করায়। ওই যারা একটা বদ্ধ কূপে কূপমণ্ডূক হয়ে থাকা, গা-জোয়ারি করে মুক্ত চিন্তাকে দাবিয়ে রাখা, ইতিহাস আর সাহিত্যই তাদের খণ্ডন করে। দুটোই আমাদের নিজেদের সীমানা পেরিয়ে ভাবতে শেখায়। এবিভিপি তথা বৃহত্তর সঙ্ঘ পরিবার আসলে আমাদের স্বাধীন ভাবনা করতে শেখাটাকে আক্রমণ করছে।

Advertisement

উত্তরপ্রদেশ ভোটের পর বৃহত্তর কথাও আসে। সঙ্ঘ পরিবার কী করতে দেবে, কী দেবে না, সেটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। সে রাজ্যে কয়েক বছর মুসলিমবিরোধী আক্রমণ লাগাতার চলছে। হিন্দু-মুসলিম প্রেম-বিবাহকে লাভ জেহাদ নাম দিয়ে বন্ধ করা, হিন্দুধর্ম থেকে অন্য ধর্মে যাওয়ার সহিংস বিরোধিতা, গোহত্যার গুজব রটিয়ে মুসলমান বা দলিতদের পিটিয়ে মারা, আর কত বলব। মানুষ বিবেকের কথা শুনে কাজ করবে, এরা তা হতে দেবে না। সর্বব্যাপী ক্ষয়ের ব্যাপারি এরা।

ট্র্যাজেডি হল যে যিনি এই লাভ জেহাদের পুরোধা, ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের শাসনভার আজ তাঁরই হাতে। এই প্রথম এক জন ধর্মগুরু, যাঁর আবার ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীও আছে, তার হাতে এত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল। এতে কি ধর্মেরও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না? ধর্ম এবং রাষ্ট্রশাসন একে অন্যের মধ্যে পুরো মিশে গেলে ধর্মের মর্যাদারও কি হানি হয় না? তাই বলছিলাম, গোটা ছবিটা আজ পরিষ্কার। শাসকগোষ্ঠী কী ভেবে কী করছে, আর সন্দেহ নেই। উত্তরপ্রদেশের মানুষ সেই ভুয়োদর্শনকে ভোটে জিতিয়ে এক রকম স্বীকৃতি বা অনুমোদন দিয়েছেন। বাকি ভারতবর্ষও কি তাই চায়?

(শেষ)

অনুলিখন: অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন