সিংহাসনে না বসেও শাসন করেছেন

স্বামী যখন মারা যান তখন পুত্রের বয়স ছিল মাত্র ছ’বছর। সেই বয়সেই পুত্রের বকলমে বর্ধমানের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন মহারানি বিষণকুমারী। আজীবন বর্ধমানের উন্নতি ও জমিদারি রক্ষা করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। লিখছেন কবিতা মুখোপাধ্যায় স্বামী যখন মারা যান তখন পুত্রের বয়স ছিল মাত্র ছ’বছর। সেই বয়সেই পুত্রের বকলমে বর্ধমানের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন মহারানি বিষণকুমারী। আজীবন বর্ধমানের উন্নতি ও জমিদারি রক্ষা করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। লিখছেন কবিতা মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৪৩
Share:

বর্ধমানের নবাবহাটে ১০৮ শিবমন্দির। (ইনসেটে) বিষণকুমারীর নামে ফলক। —ফাইল ছবি।

তিনি কোনও দিন রাজ সিংহাসনে বসেননি। তবে নাবালক পুত্রের বকলমে রাজকার্য পরিচালনা করেছিলেন। কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বুদ্ধি, সাহসিকতা এবং ধৈর্য। এই কারণেই স্মরণীয় মহারানি বিষণকুমারী। তিনি বর্ধমানের মহারাজা তিলকচাঁদের স্ত্রী। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনচেতা রাজা তিলকচাঁদের (১৭৩৩-১৭৭০) দুই স্ত্রী ছিলেন। তাঁর মধ্যে বিষণকুমারী ছিলেন দ্বিতীয়। ‘বর্দ্ধমান রাজবংশানুচরিত’ থেকে জানা যায় বিষণকুমারী মহারাজ তিলকচাঁদের একমাত্র পুত্র তেজচাঁদের ( জন্ম ১৭৬৪) মা। সেই সূত্রেই দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মহারানি হতে পেরেছিলেন।

Advertisement

বিষণকুমারী ছিলেন শেরগড় পরগনার উখড়া নিবাসী মেহেরচাঁদ হান্ডের কন্যা। মেহেরচাঁদ ছিলেন লাহৌরের মছিহাট্টা মহল্লার মানুষ। তিনি উখড়ায় এসে থাকতে শুরু করেন। তিলকচাঁদ রাজসিংহাসনে বসা থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধবিগ্রহ এবং সংঘাতের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছেন। বেদখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তি উদ্ধার এবং নিজের রাজত্বের বিস্তার এই সব কিছু করতে করতেই মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সময় তেজচাঁদের বয়স ছিল ছ’বছর। এই বয়সে রাজ সিংহাসনে বসার অসুবিধা থাকায় রানি বিষণকুমারী দশ হাজার টাকা নজরানা দিয়ে দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছে তেজচাঁদের পিতৃপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। সে কালের নিয়ম অনুসারে দিল্লীশ্বরের অনুমতি ব্যতীত তেজচাঁদ সিংহাসনে বসার অনুমতি পাবেন না। ১৭৭১ সালে শাহ আলম মহারাজাধিরাজ খেতাব দেন।

সেই সময় ওয়ারেন হেস্টিংসের নজর ছিল নাবালক তেজচাঁদের সিংহাসনের উপরে। হেস্টিংসের বিশেষ পরিচিত ছিলেন রেসিডেন্ট জন গ্রাহাম এবং ব্রজকিশোর রায় নামে দু’জন ব্যক্তি। এই ব্রজকিশোর রায় রাজ এস্টেটের ম্যানেজার নিযুক্ত হয়েছিলেন। হেস্টিংস এঁদের সাহায্যে রাজকোষের অর্থ আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে ছিলেন। কিন্তু রানি বিষণকুমারী যে কোনও সরকারি কাগজে নিজেই সিলমোহর দেওয়া এবং সিলমোহরটি সব সময় নিজের কাছে রাখায় সে সুযোগ তিনি পাননি। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তখন ব্রজকিশোর আট বছরের তেজচাঁদকে কৌশলে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নজরবন্দি করে রাখার পরিকল্পনা করেন। রানি বিষণকুমারী এই ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে সিলমোহর ব্রজকিশোরকে রাখতে দেন এবং তেজচাঁদকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। ১৭৭৪ সালে বিষণকুমারী কাউন্সিলে অভিযোগ আনেন, রেসিডেন্ট গ্রাহাম এবং গভর্নর হেস্টিংসের সম্মতিতে ব্রজকিশোর তাঁর নাবালক পুত্রের সম্পত্তির অপচয় করছেন। এই অভিযোগে দেখা যায় যে, বহু টাকা হেস্টিংস-সহ অন্যদের উৎকোচের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। বিষণকুমারী, মহারাজ নন্দকুমারের সহায়তায় রাজধন ভাণ্ডার তছরূপের দায়ে ব্রজকিশোর ও জন গ্রাহামের বিরুদ্ধে সরাসরি কাউন্সিলে আবেদন করেন। এই কাজের জন্য তাঁর রূপযৌবনের প্রতি কটাক্ষ এবং কুৎসাও করা হতে থাকে। রানির অভিযোগের ফলে, কাউন্সিল ব্রজকিশোরকে বরখাস্ত করে জমিদারির সব দায়িত্ব রানি বিষণকুমারীকে অর্পণ করে।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

তেজচাঁদের বয়স যখন ১৪ তখন বিষণকুমারী নিজের পুত্রের হাতে জমিদারির সব দায়িত্ব তুলে দিয়ে কালনায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু তরুণ রাজা ছিলেন চপলমতি এবং তাঁকে কুপরামর্শ দেওয়ার লোকেরও অভাব ছিল না। তাঁর বিলাসব্যসন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা রাজকর্মচারীদের বহু অর্থ আত্মসাৎ করতে উৎসাহী করে তোলে। এর ফলে তেজচাঁদের রাজস্ব ক্রমশ বাকি পড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত বর্ধমানের ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর মিস্টার চার্লস আর ব্রাউন ব্যাপারটা বোর্ডকে জানান, এবং মহারাজকে নজরবন্দি করে রাখেন। বোর্ড আবার বিষণকুমারীর হাতে জমিদারির সব দায়িত্ব অর্পণ করে। শর্ত দেওয়া হয় তাঁকে বকেয়া রাজস্ব দিতে হবে। নিজের সঞ্চিত অর্থ এবং কিছু জমি বিক্রি করে তিনি জমিদারি রক্ষা করেন।

কিন্তু তেজচাঁদ বারবার রাজস্ব প্রদানে অক্ষম হওয়ায় নিগৃহীত হতে থাকেন। মা বিষণকুমারী বহুভাবে তেজচাঁদকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হয়নি। যত দিন বিষণকুমারী রাজকার্য পরিচালনা করেছিলেন, তত দিন রাজস্ব মিটিয়েও জমিদারি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান পাওয়া যেত। কিন্তু তেজচাঁদ জমিদারি গ্রহণের মাত্র দশ বছরের মধ্যে ৪৪,২৯১৭ টাকা বার্ষিক খাজনা বাকি পড়ে যায়। শোধ করা দূর অস্ত্‌, উত্তরোত্তর তা বাড়তে থাকে। এর পরে বাকি রাজস্ব আদায়ের জন্য বোর্ড থেকে মহারাজার কতগুলি মহল বিক্রি করে সব টাকা উদ্ধার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। নিরুপায় রাজা তেজচাঁদ সব জমিদারি মা বিষণকুমারীর নামে করে দেন। এই সংবাদ বর্ধমান কালেক্টর বোর্ডকে জানালে মহারানির প্রতি আস্থাশীল বোর্ড জানায় যদি মহারানি সুশৃঙ্খল ভাবে রাজকার্য পরিচালনা করতে পারেন তা হলে অযোগ্য জমিদার বিষয়ক আইন থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হবে এবং মহারাজার কাছ থেকে পাওনা বাকি খাজনা রানির কাছ থেকে আদায় করা হবে।

মহারানি সঙ্গে সঙ্গে বকেয়া খাজনা পরিশোধের একটা বন্দোবস্ত করেন। বিষণকুমারী জমিদারির কিছুটা অংশ বন্ধক রেখে এবং নিজস্ব কিছু সম্পদকে ব্যবহার করে খাজনা পরিশোধ করেন। রাজা হিসেবে তেজচাঁদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা বিষণকুমারীকে কোনওদিনই স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থতা, ব্যক্তিগত জীবন প্রভৃতি কারণে তেজচাঁদের সঙ্গে রানির মতান্তর তৈরি হয়েছিল। তেজচাঁদ প্রয়াত হন ১৮৩২-এ।

বীতশ্রদ্ধ হয়ে একটা সময় তিনি বর্ধমান ছেড়ে অম্বিকা কালনায় গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। বিষণকুমারী ছিলেন ধর্মপ্রাণ মহিলা। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বহু মন্দির তৈরি করেছিলেন। তাঁর সর্বশেষ নির্মাণ ছিল বর্ধমান শহরের নবাবহাটের কাছে ১০৮টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা। ১৭৯৮ সালে মহারানির মৃত্যু হলেও, আজও বর্ধমানের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

তথ্যসূত্র: বর্দ্ধমান রাজবংশানুচরিত, রাখালদাস মুখোপাধ্যায়

বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন