সম্পাদকীয় ১

কেন প্রতিবাদ

বিশ্বে বহু দেশেই সাংবাদিকের নিরাপত্তা নাই, কিন্তু ভারত সত্যান্বেষীর হেনস্তায় অনেকের অপেক্ষা অধিক আগ্রহী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩০
Share:

অপরাধের খবর যিনি দিয়াছেন তাঁহাকেই ‘অপরাধী’ বলিয়া ধরিলে রাষ্ট্রের খুব সুবিধা হয়। অপরাধ যে হইয়াছে, তাহার সাক্ষ্য দিবে কে? কে-ই বা আর অপরাধের নালিশ করিতে সাহস করিবে? আধার কর্তৃপক্ষ পঞ্জাবের এক ইংরাজি সংবাদপত্র ও তাহার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইনভঙ্গের মামলা করিয়াছে। ইহা পুরাতন চাল। ইতিপূর্বে আধার কার্ডে সংরক্ষিত তথ্যের অপব্যবহার ফাঁস করিবার ‘দায়ে’ আরও অন্তত দুই জন সাংবাদিক অভিযুক্ত। স্বস্তির বিষয় একটিই। এই বার সাংবাদিকদের সংগঠিত প্রতিবাদের মুখে আধার কর্তৃপক্ষ তথা কেন্দ্রীয় সরকার পিছু হটিতে বাধ্য হইয়াছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ এবং আধার কর্তৃপক্ষ সোশ্যাল মিডিয়াতে জানাইয়াছেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর তাঁহাদের অটল আস্থা। বড় বিস্ময় লাগে! আস্থা যদি অটলই, তবে সাংবাদিককে জেলবন্দি করিতে এত আগ্রহ কেন? অভিযোগে কেন সাংবাদিকের নাম? কাহারা কী উপায়ে পাঁচশো টাকায় আধার-তথ্য বিক্রয় করিতেছে, সে বিষয়ে জানিতে চাহিলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের সহযোগিতার অনুরোধ আধার কর্তৃপক্ষ পূর্বেই করিতে পারিতেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর উপদেশের প্রয়োজন ছিল না। আধার কর্তৃপক্ষ বলিয়াছে, সত্য উদ্ঘাটনের জন্যই তাহারা পুলিশের দ্বারস্থ হইয়াছে। বটে? সন্দেহ হয়, সত্যভাষীকে ‘অপরাধী’ বলিয়া দাগাইয়া সত্যভাষণের কাজটিকেই ‘অপরাধ’ করিয়া তুলিবার জন্য এই মামলা দায়ের হইয়াছে। রাষ্ট্রের বাণী ‘সত্যমেব জয়তে’, কিন্তু সত্যবাদী বিপন্ন।

Advertisement

বিশ্বে বহু দেশেই সাংবাদিকের নিরাপত্তা নাই, কিন্তু ভারত সত্যান্বেষীর হেনস্তায় অনেকের অপেক্ষা অধিক আগ্রহী। একাধিক মূল্যায়নে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের স্থান শেষের সারিতে। গত বৎসর পঁয়ষট্টি জন সাংবাদিক প্রাণ হারাইয়াছেন, তিন জন ভারতীয়। নিহত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের প্রতি সমর্থন ও শ্রদ্ধা যাঁহারা প্রকাশ করিয়াছেন, সেই সাংবাদিকদেরও অনবরত হত্যা ও নির্যাতনের হুমকি মিলিয়াছে। সাংবাদিকরা সরব হইয়াছেন। সরকার মৌনী। রাহুল গাঁধী সম্প্রতি ইহাকেই হিংসার প্রতি সরকারের ‘নীরব ইঙ্গিত’ বলিয়াছেন। সাংবাদিকদের বিপর্যস্ত করিবার অপর যে উপায়টি ব্যবহারে শাসকরা অতিমাত্রায় তৎপর, তাহা মামলা দায়ের করা। গৌরী লঙ্কেশের বিরুদ্ধে একাধিক মানহানির মোকদ্দমা হইয়াছিল। অমিত শাহের পুত্রের প্রতি সরকারি স্বজনপোষণের সংবাদ প্রকাশ করিবার পরে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ও তাহার চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একশো কোটি টাকার মামলা হইয়াছে।

এমন দৃষ্টান্ত অজস্র। এবং বিবিধ রাজ্যে। অসম হইতে সংঘ পরিবারের শিশুপাচারের প্রতিবেদন লিখিবার জন্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসা উসকাইবার মামলা হইয়াছে। তামিলনাড়ুতে বালি মাফিয়ার বিরুদ্ধে লিখিবার জন্য মানহানির মোকদ্দমা হইয়াছে আর এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। রাজ্যে রাজ্যে ছোট বড় নেতারা কয়েক লক্ষ হইতে কয়েক কোটি টাকার মামলা ঠুকিতে দ্বিধা করেন না। গণতন্ত্রে সাংবাদিককে ভয় দেখাইয়া চুপ করাইবার মতো সহজ কাজ আর কী আছে? বাক্‌স্বাধীনতার সুরক্ষা সংবিধান দিয়াছে, কিন্তু সাংবাদিকের সুরক্ষা কোনও সরকার কখনও দেয় নাই। তবে ইদানীং সাংবাদিকের প্রতি যে যূথবদ্ধ হিংসা ঘটিতেছে, তাহা অভূতপূর্ব। খুন-ধর্ষণের হুমকি, গুরুতর অভিযোগ আনিয়া মামলা, প্রতিবেদককে খারিজ করিতে তাহার প্রতিষ্ঠানের উপর চাপ সৃষ্টি, এই সকলই কতিপয় নেতা ও তাহাদের অনুগামীদের ‘রাজনৈতিক কার্যক্রম’ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই কারণেই সংগঠিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রয়োজন। সাংবাদিকদের সমবেত প্রতিবাদে যে এক দিনের মধ্যেই পিছু হটিল সরকার, এই সংবাদও কম গুরুত্বপূর্ণ নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন