সম্পাদকীয় ১

তবু সংশয়

লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকিলেও রাজ্যসভায় বিজেপির সেই জোর ছিল না। অতএব, অর্থ বিলই একমাত্র পন্থা ছিল, যাহাতে রাজ্যসভাকে পাশ কাটাইয়া আইন পাশ করাইয়া লওয়া যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রতীকী ছবি।

পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের চার জন জানাইয়াছেন, আধার সাংবিধানিক ভাবে বৈধ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতই মান্য, তবে বিচারপতি ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড়ের পৃথক রায়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। তিনি যে প্রশ্নগুলি তুলিয়াছেন, ভারতীয় গণতন্ত্রের নিকট সেগুলির তাৎপর্য অপরিসীম। আধার বিলটি আদৌ অর্থ বিল কেন হইবে, তাহার সংবিধানসিদ্ধ উত্তর নাই। রাজনৈতিক উত্তরটি স্পষ্ট— লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকিলেও রাজ্যসভায় বিজেপির সেই জোর ছিল না। অতএব, অর্থ বিলই একমাত্র পন্থা ছিল, যাহাতে রাজ্যসভাকে পাশ কাটাইয়া আইন পাশ করাইয়া লওয়া যায়। তাহাতে বিল পাশ হইয়াছে ঠিকই, কিন্তু বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের কথা ধার করিলে বলিতে হয়, সংবিধানের অমর্যাদাও হইয়াছে। গণতন্ত্রের প্রতি বর্তমান শাসকদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা রহিয়াছে, এমন দাবি পরম ভক্তও করিবেন না। দ্বি-কক্ষ সংসদের উচ্চতর কক্ষকে এড়াইয়া এমন সর্বাত্মক একটি বিল পাশ করাইয়া লওয়ার চেষ্টায় সেই অশ্রদ্ধাই কি প্রকট হইয়া উঠে না?
সর্বোচ্চ আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়াছে, কোনও বেসরকারি সংস্থা নাগরিকের নিকট আধার চাহিতে পারে না। তথ্য-নিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শীর্ষ আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়া বলা প্রয়োজন, সিদ্ধান্তটির পরও কিছু প্রশ্ন থাকিয়া যায়, তাহা সরকারি তথ্য প্রসঙ্গে। সরকারের নিকট জমা থাকা তথ্যও কি আদৌ নিরাপদ? সাম্প্রতিক অতীতে এই অভিযোগ বারংবার উঠিয়াছে। এবং, তাহা ভিত্তিহীন, এমন কথা সরকারও জোর দিয়া প্রতিষ্ঠা করিতে পারে নাই। অতএব, মূল প্রশ্নটি বেসরকারি হাতে তথ্য যাওয়ার নহে, বরং তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার। আধার কর্তৃপক্ষ যে ব্যক্তিপরিসরের অধিকার লঙ্ঘন করিয়া নাগরিকের বহুবিধ তথ্য জমা রাখেন, সেই কথাটি তাঁহারাই স্বীকার করিয়াছেন। রাষ্ট্রীয় নজরদারির ক্ষেত্রে তাহা মারাত্মক অস্ত্র হইতে পারে। ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকারকে মানুষের মৌলিক অধিকারের মর্যাদা সর্বোচ্চ আদালতই দিয়াছে। সুতরাং আধার-এর সাংবিধানিকতা বিচারের ক্ষেত্রে সেই প্রসঙ্গটিও উঠে বইকি।
কাহারও বয়ঃক্রম আঠারো হইলে সে নিজেই সিদ্ধান্ত করিবে যে সে আধার-ব্যবস্থায় থাকিবে কি না— জানাইয়াছে শীর্ষ আদালত। অর্থাৎ, আধার বাধ্যতামূলক নহে। কিন্তু, আয়করের রিটার্ন দাখিল করিতে হইলে যেখানে আধার লাগিবেই, সেখানে এই ছাড়ের অর্থ কিছু অস্পষ্ট। কেহ যদি সরাসরি রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী না হইয়াই বাঁচিতে পারে, হয়তো একমাত্র তাহার ক্ষেত্রেই আধার না করাইবার স্বাধীনতা থাকে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ভর্তুকি বা পেনশনের ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক, রাষ্ট্রীয় বৃত্তির ক্ষেত্রেও সরকার আধার দাবি করিতে পারে। আদালত রায় দিয়াছে, রাষ্ট্রের নিকট হইতে সুবিধা লইতে গেলে নাগরিককে নিজের ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তা রক্ষার দাবি ছাড়িতে হইবে। ভাবিতে হয়, ইহা কি রাষ্ট্রদর্শনের দিক দিয়া নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটিকে কঠিন করিয়া দিবে না? ভর্তুকি তো কোনও অর্থেই নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের দাক্ষিণ্য নহে, তাহা নাগরিকের অধিকার। সেই অধিকার আদায় করিবার পথে তাহার সহিত ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হইতে পারে। শীর্ষ আদালত স্পষ্টত উল্লেখ করিয়াছে যে, আধার না থাকিবার কারণে কাহাকেও কোনও সুবিধা হইতে বঞ্চিত করা চলিবে না। তবে সরকারি বঞ্চনার যে ধারাটি এ দেশে চলিয়া আসিতেছে, তাহাতে অনুমান সম্ভব যে, ছাড়টি সাময়িক। সরকারি ভর্তুকির জন্য আধার দাখিল করিবার বাধ্যবাধকতা হইতে আপাতত নিষ্কৃতি মিলিলেও রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীরা নিয়মিত নিষ্কৃতি মঞ্জুর করিবেন কি না, বলা মুশকিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন