‘শাপ’মোচন

রূপান্তরকামীদের জনসংখ্যার অনুপাতে ‘অন্যান্য’ ভোটার হিসাবে নাম নথিভুক্তকরণের সংখ্যা অত্যন্ত কম। গত পাঁচ বৎসরে তাহাতে যৎসামান্য বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৯ ০০:২০
Share:

চিরপি ভবানী।

অন্যান্য’ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকারের ক্ষেত্রে চলমান লোকসভা নির্বাচনে একটি নূতন ইতিহাস তৈরি হইল, এই কথা এখন জোর দিয়া বলা চলে। এই প্রথম কোনও রূপান্তরকামী প্রার্থী হইয়া নির্বাচনে লড়িতেছেন। আপ-এর টিকিটে প্রয়াগরাজ হইতে লড়িতেছেন চিরপি ভবানী। আবার, মহারাষ্ট্র হইতে রূপান্তরকামী সমাজকর্মী গৌরী সবন্ত হইয়াছেন নির্বাচন কমিশনের শুভেচ্ছা-দূত। তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহিত করিতে চলিয়াছেন গৌরী। এই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকরা তাঁহাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করিতে যাইতেছেন। এবং ভোট দিয়া আসিয়া বলিতেছেন, সমাজে যে তাঁহাদের একটি ‘বৈধ’ স্থান আছে, তাহা প্রমাণের সুযোগ পাইয়া তাঁহারা খুশি, উদ্বেগমুক্ত। প্রসঙ্গত, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলিতেও এই বার ইতিহাসের ছোঁয়া। রূপান্তরকামীদের লইয়া বৈষম্যমুক্ত আইন তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়াছে কংগ্রেস। বিজেপির ইস্তাহারেও তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত বা রূপান্তরকামীদের ক্ষমতায়নের কথা আছে। রূপান্তরকামীদের অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট করিয়াছে সিপিএমের ইস্তাহার। এই বারের লোকসভা নির্বাচন এই জন্য আলাদা ভাবে ঐতিহাসিক হইয়া রহিল। ইহার পূর্বে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এত স্পষ্ট ভাবে রূপান্তরকামী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার লইয়া আলোচনা হয় নাই।

Advertisement

বড় করিয়া দেখিলে, সামাজিক পরিবর্তনের সূচনাটিও স্পষ্ট। রূপান্তরকামীদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরাইবার সচেতন প্রয়াস ইতিমধ্যেই শুরু হইয়াছে। নির্বাচনে ভোটার এবং প্রার্থী হিসাবে আরও সক্রিয় ভাবে তাঁহাদের অংশগ্রহণ সেই প্রচেষ্টাকেই জোরদার করিবে। নির্বাচন তো শুধুমাত্র একটি দলের হার-জিতের খতিয়ান নহে। তাহা একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দাঁড়াইয়া নিজেদের সমস্যাগুলি স্পষ্ট ভাষায় তুলিয়া ধরা যায়, অ-প্রাপ্তিগুলির বিরুদ্ধে স্বর উঠানো যায় এবং অন্য গোষ্ঠীর মানুষের সমর্থন আদায় করা যায়। যে দাবিদাওয়াগুলি এত কাল ক্ষুদ্র পরিসরেই আবর্তিত হইত, রাজনীতি সেগুলিকে পরিচিত বৃত্তের বাহিরে আরও অনেক মানুষের কানে পৌঁছাইয়া দিবে। একের স্বর অনেকের স্বরে পরিণত করিবার অবকাশ দিবে। রূপান্তরকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সামাজিকীকরণে নির্বাচনে যোগদান তাই একটি আশার সংবাদ।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

Advertisement

তবু মনে রাখা ভাল, এখনও অনেক পথ চলা বাকি। বস্তুত, রূপান্তরকামীদের জনসংখ্যার অনুপাতে ‘অন্যান্য’ ভোটার হিসাবে নাম নথিভুক্তকরণের সংখ্যা অত্যন্ত কম। গত পাঁচ বৎসরে তাহাতে যৎসামান্য বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হইয়াছে। নিজেদের পরিচয় প্রমাণে যে বিপুল পরিমাণ নথিপত্র দাখিল করিতে হয়, নাম নথিভুক্তকরণে অনাগ্রহের তাহাও অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা যায়। তদুপরি, ভোটার তালিকায় স্থান মিলিলে বা প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন লড়িলেই যে যাবতীয় সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে, তেমনটা নহে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মেয়েদের অধিকারের কথা। এক কালে আশা করা হইত, মেয়েরা যত বেশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করিবেন, মেয়েদের সমস্যাও তত বেশি আলোচিত হইবে, ক্রমে তাঁহাদের অধিকারগুলিও প্রতিষ্ঠিত হইবে। কিন্তু রাজনীতিতে মেয়েদের প্রবেশ বৃদ্ধি পাইলেও বহু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার আজও সমাধান হয় নাই। শবরীমালা মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশাধিকার দান লইয়া যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মিছিল দেখা গেল, তাহা এই দুর্ভাগ্যজনক কথাটি স্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করে। একই ভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও, অধিকার পার হইয়া সামাজিক বৈষম্যের পুনরাবৃত্তি হইবার সম্ভাবনা আছে বইকি। সুতরাং, ভোটের অধিকারকে আলোর রুপালি রেখামাত্র বলা যায়। রেখাটি যাহাতে মিলাইয়া না যায়, তাহা এখন নিশ্চিত করা কর্তব্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন