ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কিম জং-উন।
অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রূপ নেয় প্রকৃতির কোনও তাণ্ডব। যে কোনও শক্তিশালী ঝড় ভয়াবহ ধ্বংসলীলায় পরিণতি পায়।
কোনও এক সায়াহ্নে এই ভূ-ভাগের কোনও এক প্রান্তে তির তির করে বয়ে যায় যে মৃদু বাতাস, ধ্বংসলীলা চালানোর ক্ষমতা বা গতিপথে ছাপ রেখে যাওয়ার কেরামতি কিন্তু সে বাতাসের নেই।
একই প্রকৃতির দুই রূপ— প্রথম রূপটিকে সকলেই এড়িয়ে চলতে চান, দ্বিতীয়টি রীতিমতো জনপ্রিয়। মহাশক্তিধর আয়লা বছরের পর বছর ধরে দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়ে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে। অনাম্নী কোনও সায়াহ্নের মৃদুমন্দ সমীরণ কোনও প্রখ্যাত নাম পায় না, কিন্তু হৃদয়ে মিশে থাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই। সক্ষম তা হলে কে? আয়লা, নাকি নামগোত্রহীন সায়াহ্ন সমীরণ? স্থির বিশ্বাস নিয়ে বলে দেওয়া যায়, সক্ষম দ্বিতীয়টিই।
সক্ষমতা আসলে একটি ইতিবাচক ধারণা। যে কোনও সক্ষমতাই আমাদের পারিপার্শ্বিকতায় কোনও না কোনও ইতিবাচক বদল আনে। যে বদল নীতিবাচক, তা সক্ষমতা হতে জাত নয়। দুর্যোগের প্রবল শক্তিকে প্রকৃতির সক্ষমতা হিসেবে ধরলে ভুল হয়। দুর্যোগ আসলে প্রকৃতির এক আত্মঘাতী দুর্বলতা। এই আত্মঘাতী দুর্বলতাতেই ফের ডুব দিতে দেখা যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বা কিম জং-উনকে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
আশার প্রদীপগুলো একে একে জ্বলে উঠতে শুরু করেছিল। প্রেক্ষাপটে যখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত সিরিয়া, প্রেক্ষাপটে যখন ক্ষতবিক্ষত ইরাক, তখন আরও নতুন নতুন যুদ্ধের আশঙ্কা মুছে দিয়ে শান্তির প্রদীপ জ্বলে উঠছিল এ পৃথিবীর অন্য কয়েকটি প্রান্তে। বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশে পুণর্গঠনের কাজ গতি পাচ্ছিল। দশকের পর দশক ধরে বিবদমান দুই কোরিয়া বিদ্বেষ ভুলে কাছাকাছি আসা শুরু করেছিল। পরস্পরের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দেওয়া আচমকা বন্ধ করে দিয়েছিল উত্তর কোরিয়া এবং আমেরিকা। উত্তর কোরীয় শাসক কিম জং-উনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক নির্ঘণ্ট নির্ধারিত হয়েছিল। গোটা পৃথিবী আশায় বুক বাঁধছিল। ভয়াবহ কোনও পরমাণু যুদ্ধের আঘাত আর সইতে হবে না পৃথিবীকে, বিবদমান দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের বরফ গলছে, ওয়াশিংটন ডিসি এবং পিয়ংইয়ং ক্রমশ পরস্পরের কাছাকাছি আসছে, যুদ্ধটা অন্তত এড়িয়ে যাওয়া যাবে, এটুকু আশা করাই যায়— ভাবছিল গোটা বিশ্ব। কিন্তু বিধাতা সম্ভবত পরিহাসের মেজাজে ছিলেন। তাই আশার প্রদীপগুলো জ্বলে উঠেও একে একে নিভতে শুরু করল যেন।
আরও পড়ুন: কিমের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করলেন ট্রাম্প
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে বহুজাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল আমেরিকা। ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিতে রাশ টানার অঙ্গীকার করেছিল। আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার অঙ্গীকার করেছিল। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠেনি ঠিকই, কিন্তু সম্পর্কের উন্নতি হয়েছিল। আচমকা ফের তলানিতে ইরান-আমেরিকার সম্পর্ক। চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে এসেছে আমেরিকা, ইরানের বিরুদ্ধে কঠোরতর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেছে তারা, পাল্টা সুর চড়াচ্ছে তেহরানও।
আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে আমেরিকার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ভারতেরও। কিন্তু পুনর্গঠনের সেই ভারতীয় উদ্যোগ ভেস্তে দেওয়ার চক্রান্ত ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। আফগানিস্তানে কর্মরত ভারতীয়দের উপরে আক্রমণ বেড়েছে, সম্প্রতি ৭ ভারতীয় অপহৃত হয়েছেন।
সম্প্রতি গোটা বিশ্বকে প্রায় চমকে দিয়েই পরস্পরের সঙ্গে বৈঠকে রাজি হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং-উন। কিন্তু আচমকা উত্তর কোরিয়ার তরফ থেকে কড়া বয়ান শোনা গেল আমেরিকার বিরুদ্ধে। সেই বয়ানকে তুলে ধরে আমেরিকা জানিয়ে দিল, এর পরে আর বৈঠক সম্ভব নয়। অর্থাৎ আবার পরস্পরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আমরিকা ও উত্তর কোরিয়া, আবার তীব্র চোখরাঙানি পরস্পরকে, আবার আকাশে আশঙ্কার মেঘ— আরও একটা পরমাণু যুদ্ধ নয় তো!
শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়া অপরাধ নয়। সামরিক সক্ষমতা থাকা দোষের বিষয় নয়। কিন্তু সে সক্ষমতা মানবজাতির মঙ্গলার্থে কাজে লাগাটাই কাম্য। মানবজাতিকে নতুন করে কোনও ধ্বংসলীলার মুখোমুখি দাঁড় করানো হোক, এমনটা কাঙ্খিত নয়। তাই কিম আর ট্রাম্প যখন শান্তি বৈঠকের দিকে এগোতে শুরু করেছিলেন, তখন হাসি চওড়া হয়েছিল কোটি কোটি মানুষের মুখে। দু’দেশ ফের পরস্পরের বিরুদ্ধে হুঙ্কারের যুগে ফিরে যাওয়ায় সে হাসি বিলীন হয়েছে, আকাশে আবার আশঙ্কার মেঘ জমতে শুরু করেছে।
আবার বলি, দুর্যোগ কাঙ্খিত নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প, কিম জং-উন, হাসান রোহানি— সকলকেই বুঝতে হবে সে কথা। এই ঘটনাপ্রবাহের কোথাও সক্রিয় শি চিনফিং, কোথাও ভূমিকা রয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের, কোথাও আবার অরাষ্ট্রীয় শক্তি চাঞ্চল্য তৈরি করছে— মত অনেকের। প্রকাশ্যে হোক বা নেপথ্য থেকে, কোনও দায়িত্বশীল শক্তির ভূমিকাই নীতিবাচক হওয়া উচিত নয়। আমেরিকা, চিন, রাশিয়া— সকলেই বৃহৎ শক্তি। উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্রে বলীয়ান, ইরান পরমাণু কর্মসূচি রূপায়নে তৎপর। কোনও দেশ সরাসরি, কোনও দেশ আড়াল থেকে এমন ভূমিকা নিতে শুরু করেছে আচমকা যে, দুর্যোগ ঘনিয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে আবার। মনে রাখা দরকার, দুর্যোগ কিন্তু কারও সক্ষমতা প্রমাণ করবে না। দুর্যোগ ভয়াবহ ধ্বংসলীলার ছাপ রেখে যাবে, দুর্যোগ দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়ে যাবে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। যদি বৈরিতার ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া যায়, তপ্ত সম্পর্কের পরিসরে যদি একটু সুশীতল হাওয়া খেলিয়ে দেওয়া যায়, সক্ষমতা প্রমাণিত হবে তাতেই। ট্রাম্প থেকে কিম বা রোহানি, মনে রাখা দরকার এ কথা প্রত্যেকেরই। হয়তো এ কথাটা মনে রাখা দরকার এখন চিনফিং বা পুতিনেরও। সক্ষমতার প্রমাণ মিলবে তাতেই।