অস্ত্রোপচারের পরে হাসপাতালে কৃষ্ণেন্দু। —নিজস্ব চিত্র।
পরিপার্শ্বের ঘটনাপ্রবাহ দেখিলে কেবলই সন্দেহ হয়, আধুনিক পৃথিবীতে কাণ্ডজ্ঞান নামক বস্তুটির নিতান্তই আকাল। উদয়নারায়ণপুরের দশম শ্রেণির ছাত্রটি যেমন বেঘোরে মরিতে বসিয়াছিল। এক প্রতিযোগিতায় খুন হওয়া বালকের ভূমিকায় অভিনয় করিবার সময় আচমকা দুর্ঘটনায় ছুরি তাহার পেটে আমূল বসিয়া যায়। গুরুতর জখম হয় পাকস্থলী। প্রাণে সে বাঁচিয়াছে ঠিকই, কিন্তু একটি প্রশ্ন তুলিয়া দিয়াছে। তারিফ কুড়াইবার নেশায় কি স্বাভাবিক বোধকেও বিসর্জন দিতে হয়? কাণ্ডজ্ঞান তো স্বাভাবিক বোধেরই অপর নাম। কী করিলে কী হইতে পারে, সেই বিষয়ে সম্যক ধারণা। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান যাহাকে ক্রমশ পুষ্ট করে। আসল ছুরি লইয়া খেলিবার সময় সামান্য অসর্তকতাই যে ভয়ঙ্কর বিপদ ডাকিয়া আনিতে পারে, ইহাই তো সেই স্বাভাবিক বোধ। এক দশম শ্রেণির বালকের মধ্যে সেই বোধ থাকিবে না? তর্কের খাতিরে যদি ধরিয়া লওয়া যায় যে বয়সের তুলনায় তাহার সেই বোধ জাগ্রত হয় নাই, তাহা হইলে প্রশ্ন জাগে, তাহার অভিভাবকরা কী করিতেছিলেন, অথবা প্রতিযোগিতার আহ্বায়করা?
কাণ্ডজ্ঞান হারাইবার উদাহরণ এই একটিমাত্র নহে। সিনেমা বা সিরিয়ালের দৃশ্য নকল করিতে গিয়া প্রাণহানির উদাহরণও প্রচুর। বিশেষত শিশুদের মধ্যে এই প্রবণতা অত্যধিক। নিজের প্রিয় চরিত্রের কার্যকলাপ নকল করিতে গিয়া মৃত্যুর ঘটনায় শিশু এবং কিশোরদেরই সংখ্যাধিক্য। শিশুদের তবু অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু অভিজ্ঞতার ঝুলিটি পূর্ণ হইলেই যে স্বাভাবিক বোধটিও পাল্লা দিয়া বাড়িবে, এমন নহে। বিপরীতটিও হামেশাই ঘটিয়া থাকে। অনেক ঘটনার কথা শুনিলে মনে হয় না তাহা কোনও বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাজ। অথচ, কুকর্মকারী হয়তো বয়ঃপ্রাপ্তির সময়সীমা কবেই পার করিয়া আসিয়াছেন। যাহারা উৎসবের নামে উৎকট শব্দের উপাসনা করে, হাসপাতাল চত্বরে মাইক বাজাইয়া মোচ্ছবে মত্ত হয়, কাণ্ডজ্ঞান কি তাহাদেরই আছে? প্রায় প্রতি দিন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের সংবাদ প্রকাশিত হয়। কেহ রাগের বশে সহযাত্রীকে মারিয়া ফেলিতেছেন, কেহ গাফিলতি বা অন্যায়ের অভিযোগে স্কুলে বা হাসপাতালে তাণ্ডব করিতেছেন, কেহ বা মৃতদেহ আগলাইয়া সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটাইয়া দিতেছেন! একটি অপ্রকৃতিস্থ সমাজের মুখচ্ছবি চতুর্দিকে প্রকট।
তবে মানিতেই হইবে, কাণ্ডজ্ঞান হারাইবার প্রতিযোগিতায় রাজনৈতিক নেতাদের তুল্য সাফল্য আর কাহারও নাই। ইতিহাস প্রমাণ, একচ্ছত্র ক্ষমতা বিস্তার করিতে হইলে সর্বাগ্রে নিজ কাণ্ডজ্ঞান বর্জন করিতে হয়। বর্তমানও তাহাই বলিতেছে। ক্ষমতায় আসিবার পর অনেকেই সেই বস্তুটি সযত্নে পরিত্যাগ করেন। অধুনা দেশে যে রূপ প্রাচীন ঐতিহ্যের ঢাক পিটাইবার রাজনীতির আমদানি হইয়াছে, এবং প্রমাণ হিসাবে যে কাল্পনিক উদাহরণ টানিয়া আনা হইতেছে, তাহাতে বয়সের সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞানের সহজ সম্পর্কটি জোরদার ধাক্কা খায়। প্রবীণ নেতারা অহরহ ভয়াবহ রকমের অবিশ্বাস্য সমস্ত কথা প্রচার করিতেছেন, প্রবীণ নাগরিকরা তাহা বিশ্বাস করিতেছেন! উদয়নারায়ণপুরের বালকটির বোধহীনতা তো সেই তুলনায় যৎসামান্য।