শিশুরা খেতে পেলে তবেই তো শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম হবে

শহরের নামীদামি বিদ্যালয়ের বদলে মফস্সল বা গ্রামের বিদ্যালয়গুলির দিকে নজর দিলে অবশ্য প্রয়োজনটা পরিষ্কার হয়ে যায় ।

Advertisement

সঞ্জয় মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৯ ০০:৫৫
Share:

কয়েক দিন আগে একটি বালিকা বিদ্যালয়ের মিড-ডে মিলে শুধু নুন-ভাত খাওয়ানোর মতো যে জঘন্য ঘটনা ঘটেছে। ফাইল চিত্র

বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিলের গুণগত মানের বিষয়ে আরও বেশিমাত্রায় সচেতন হওয়া জরুরি নয় কি? বিশেষত, যে দেশে শিশু অপুষ্টির হার এত বেশি?

Advertisement

আমাদের দেশের সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সরকার থেকে বরাদ্দ মিড-ডে মিল যে কতটা প্রয়োজনীয় বা জরুরি, তা শহরের মানুষ বুঝতে পারবেন না। শহরের নামীদামি বিদ্যালয়ের বদলে মফস্সল বা গ্রামের বিদ্যালয়গুলির দিকে নজর দিলে অবশ্য প্রয়োজনটা পরিষ্কার হয়ে যায় ।

এখনও গ্রামের দিকের স্কুলের এই মিড-ডে মিলের খাবারই একটা বড় অংশের ছেলেমেয়েদের গোটা দিনের প্রধান ও পুষ্টিকর খাবারের মূল উৎস। আমাদের মতো দেশ যেখানে শতাংশের হিসাবে অধিকাংশ মানুষই দারিদ্রসীমার নীচে অবস্থান করেন, তাঁদের কাছে সন্তানের শিক্ষার তুলনায় খাদ্যের চাহিদাই প্রাথমিক। আর এই প্রাথমিক চাহিদা পূরণ হলে তবেই মানুষ পরবর্তী চাহিদার দিকে ঝোঁকে বা তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় সুকান্তের একটি কবিতার লাইন— “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’’।

Advertisement

গ্রাম বা মফস্‌সলের দিকের স্কুলগুলিতে এই মিড-ডে মিলের প্রয়োজনীয়তার কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু তার পরেও মিল-ডে মিল নিয়ে বহু বার বিভিন্ন স্কুলের বিচ্ছিন্ন ঘটনা সামনে আসছে। কোথাও মিড-ডে মিল নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে, কোথাও খারাপ মানের খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে। সে সব প্রকাশ্যে আসার পরেও আমাদের দেশ, আমাদের সরকার, আমাদের প্রশাসন নির্বিকার। কেন? এই খাদ্যের অধিকার লঙঘন করা কি কোনও একটি সভ্য দেশে অভিপ্রেত?

অন্য দিকে, মিড-ডে মিল নিয়ে যখনই কোনও ঘটনা সামনে আসে, তখনই সমাজের সবস্তরের মানুষ তাঁর আঙুল মুহূর্তের মধ্যে তাক করেন সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দিকে। ভেবেই নেওয়া হয় এর দায় শিক্ষকদের। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী থাকেন?

মিড-ডে মিল নিয়ে যখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়, বিশিষ্টজনেরা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেন মিড-ডে মিলের মান এবং তার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন মতামত। সেখানে নিহিত থাকে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিল বঞ্চনার প্রতি গভীর উদ্বেগ, চিন্তা। কিন্তু কিছু সময় পরেই সে সব সামাজিক বোধ ও চিন্তন যেন জলে ভেসে ওঠা ফেনার মতো বিলীন হয়ে যায় সমাজ ও জনসমুদ্রের আপনাপন ব্যস্ততায়।

আজকের দিনে যেখানে বাজারে সমস্ত জিনিসপত্রের দামই আকাশছোঁয়া, যেখানে বাড়ির জন্য আনাজ, মাছ-মাংস-ডিম বাজার করতে গেলে মানিব্যাগ ভর্তি টাকা নিমেষে ফুরিয়ে যায় এক ব্যাগ ভর্তি বাজারের বিনিময়ে, সেখানে পড়ুয়াদের স্কুলে মিড-ডে মিল জোগান দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা খুব স্বাভাবিক। ভাবতে হবে, মিড-ডে মিল বাবদ প্রতিটি পড়ুয়ার জন্য মাথা পিছু বরাদ্দ হওয়া ওই সামান্য মূল্যে কী ভাবে পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান তাদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব?

বিষয়টা নিয়ে আমাদের সকলেরই ভাবা উচিত। এর উপরে আবার রয়েছে মুদি দোকানের বাজার-ফর্দ। সবমিলিয়ে মাথাপিছু যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা কখনওই বরাদ্দ অর্থের দ্বারা সম্ভব হয় না। ফলে, কখনও কখনও শিক্ষক-শিক্ষিকারা চাইলেও তাঁরা নিজেদের সন্তানসম ছাত্রছাত্রীদের পাতে ভাল খাবার তুলে দিতে সক্ষম হন না।

এর পরও আছে আরও নানা সমস্যা। যেমন , মিড-ডে মিলের জন্য যে চাল বরাদ্দ করা হয় বা সরকারি দফতর থেকে স্কুলগুলিতে যে চাল সরবরাহ করা হয়, কখনও কখনও তার মান এতটাই খারাপ হয় যে, তা রান্না করলে বহু ছাত্রছাত্রীই খেতে পারে না। এর পরেও আছে বস্তায় চালের পরিমাণের কম-বেশির প্রশ্ন। ফলে, এত কিছুর পরে বিদ্যালয়ের মিড-ডে মিলের খাদ্যের গুণগত মান যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক দিন আগে একটি বালিকা বিদ্যালয়ের মিড-ডে মিলে শুধু নুন-ভাত খাওয়ানোর মতো যে জঘন্য ঘটনা ঘটেছে, সেটি অত্যন্ত নিন্দনীয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ-সহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সে বিষয়ে অনেক আগেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানানো উচিত ছিল।

তবে, চারপাশের বহু স্কুল তথা আমার নিজের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল খাওয়ানোর বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। এক জন শিক্ষক হিসাবে প্রশাসন ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এটাই আবেদন রাখব যে, যেন এই সব পড়ুয়ার জীবনের প্রাথমিক চাহিদাটির বিষয় মাথায় রাখা হয়। কী ভাবে মিড-ডে মিলের মান ভাল করা যায় কিংবা স্কুলপড়ুয়ারা খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে কি না, সে দিকে প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টি থাকে।

একমাত্র তবেই আমাদের দেশের প্রতিটি না-খেতে-পাওয়া শিশু পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণে সমর্থ হবে। সামগ্রিক ভাবে সমাজ উন্নত হবে।

লেখক উজিরপুকুরিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন