গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পায়ে পায়ে সম্ভবত একটা পূর্ণাঙ্গ সাবালকত্বের দিকে আমরা। প্রগতির স্বাভাবিক ধারণা অন্তত তেমনই বলছে। সঙ্গী নির্বাচনের প্রশ্নে যে একমাত্রিক-একরঙা বাধ্যবাধকতা সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ জুড়ে চাপিয়ে আসছিল সমাজ, সংবিধানের ৩৭৭ ধারাকে অকেজো করে সে বাধ্যবাধকতাকে সম্প্রতিই ঝেড়ে ফেলেছে ভারতীয় বিচার বিভাগ। যৌনতার অধিকার হয়েছে সাতরঙা। এ বার ঝেড়ে ফেলা হল ধারণার আর এক আঁধার। পরকীয়া রোধের নামে স্ত্রীয়ের উপরে স্বামীর প্রভু ত্ব প্রতিষ্ঠাকে বহু বছর ধরে স্বীকৃতি দিয়ে আসছিল যে আইন, সংবিধানের সেই ৪৯৭ ধারাকে এ বার অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হল। সামাজিকতার উপলব্ধিতে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করল যেন ভারত।
সামাজিক এবং যৌন সম্পর্কের ধারণাকে এ দেশে ঘিরে রেখেছিল নানা অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা। দুর্ভেদ্য পর্দার মতো ছিল ঘেরাটোপগুলো, আলো-হাওয়া পৌঁছত না ধারণায়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর কয়েকটা রায় দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একে একে যেন খুলে দিল অনেকগুলো দরজা-জানালা। এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়াল ভারত।
নেই তবু রয়েছে— পরকীয়ার অস্তিত্বটা এ দেশে, এ সমাজে অনেকটা এ ভাবেই ছিল এত দিন। এ দেশের পুরাণ, পুরাণ পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য, চারুকলা, দৃশ্যকলা— জীবন-সমাজ-ভাবনার প্রতিফলনের এই প্রতিটি শাখাকে অজস্র বার স্পর্শ করে গিয়েছে পরকীয়া। বেদব্যাসের মহাভারত থেকে কালিদাসের কাব্য, রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ থেকে শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’— বার বার প্রতিফলিত হয়েছে এ সমাজে পরকীয়ার অস্তিত্ব। খানিকটা অনুচ্চারে প্রতীত হয়েছে যে, পরকীয়ায় সাংঘাতিক অস্বাভাবিকতা বোধ হয় নেই। কিন্তু অস্তিত্বশীল সে হোক বা না হোক, অস্বাভাবিক সে হোক বা না হোক, অনৈতিক এবং অন্যায় যে সে অবশ্যই, সামাজিকতার কাঠামো বার বার তা মনে করিয়ে দিয়েছে। উনবিংশ শতকের আইনটা প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকতার সেই কাঠামোয় পাকাপোক্ত সিলমোহর দিয়েছিল। সেই মোহরটাকেই সরিয়ে নিল সুপ্রিম কোর্ট। প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকতাকে ভারতের শীর্ষ আদালত বার্তা দিল, শৃঙ্খলগুলোকে আলগা করতে হবে এ বার।
আরও পড়ুন: পরকীয়া অপরাধ নয়, স্বামী প্রভু হতে পারেন না স্ত্রীর, রায় সুপ্রিম কোর্টের
সুপ্রিম কোর্ট পরকীয়া সংক্রান্ত মামলায় যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে, তার বহুমুখী তাৎপর্য রয়েছে। তবে অন্যতম প্রধান দুই তাৎপর্য বোধ হয় বিশেষ আলোচ্য:
প্রথমত, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের উচ্চারণ খুব স্পষ্ট— স্ত্রী কখনওই স্বামীর সম্পত্তি নন। বিবাহিত নারীর স্বামীর অগোচরে সে নারীর সঙ্গে কেউ পরকীয়ায় জড়ালে তা অপরাধমূলক কাজ হিসেবে গণ্য হবে। যে পুরুষ পরকীয়ায় জড়ালেন, তাঁর কারাদণ্ড-জরিমানা হবে। আইন ছিল এই মর্মেই। অর্থাৎ, নারীটির কোনও ভূমিকা নেই এই সম্পর্কে। নারীটি হলেন তাঁর স্বামীর সম্পত্তি। তাই সম্পত্তির মালিকের আপত্তি না থাকলে অন্য কোনও পুরুষ নারীটির যৌন জীবনে প্রবেশ করতেই পারেন। কিন্তু মালিককে না জানিয়ে সম্পত্তি স্পর্শ করা দণ্ডনীয়। একজন নারীর জন্য এর চেয়ে অপমানজনক সংস্থান আর কটা হতে পারে! সুপ্রিম কোর্টের রায় শতাধিক বছরের সেই অপমানকে এ বার ছুড়ে ফেলে দিল।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
দ্বিতীয়ত, সমাজের একটা অপ্রয়োজনীয় মুখোশ সর্বোচ্চ আদালত খুলে নিল। পরকীয়াকে সামাজিক স্বীকৃতি বা বৈধতা ভারতীয় সমাজ দিত না। সুদীর্ঘ কালের এই বিচার যে সময়ে এবং যে সামাজিক কাঠামোর প্রেক্ষিতে জন্ম নিয়েছিল, সেই সময় এবং সামাজিক কাঠামোর জন্য এই বিধি সত্যিই প্রয়োজনীয় ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আপাতত তোলা থাক। বর্তমানের সামাজিক কাঠামোটা যে রকম, আধুনিক মূল্যবোধ যে রকম, তাতে এই আইনটাকে মেনে নেওয়া আর সম্ভব ছিল কি না, তর্ক হোক এখন তা নিয়েই। সে তর্কে গেলে আমরা দেখতে পাব, সামাজিক ও যৌন সম্পর্কের সংজ্ঞা, অবকাশ, ছাঁচ ইত্যাদি আমূল বদলে গিয়েছে এখন। যে সময়ের মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা এবং নৈতিকতার উপরে দাঁড়িয়ে ১৮৬০ সালে এই আইনটা প্রণীত হয়েছিল, আজকের মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, নৈতিকতার বোধ তার চেয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে। আসলে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পথের দু’প্রান্তে সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলাতে থেকেছে। চেতনার নানা অন্ধকার ক্রমশ কেটে যেতে থেকেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সমাজ যে যৌনতায় সিলমোহর দেয়, তার বাইরেও যে অবাধ ও ঘনিষ্ঠ মেলামেশা সম্ভব, এ সমাজের উপলব্ধিতে তা ধরা দিয়েছে। কিন্তু সমাজ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সে উপলব্ধিকে প্রকাশ করেনি। বরং সম্পর্কের এই সম্ভাব্যতাগুলো নিয়ে লুকোচুরি চালিয়ে গিয়েছে নিরন্তর। এই লুকোচুরিটাই সম্ভবত ঘোর অনৈতিক ছিল। অভ্যাসে এক, প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকতার শিখিয়ে দেওয়া ভাষ্যে আর এক— এই দ্বিচারিতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বোধহয় অনেকেই। তাই বহু বছর ধরে এই তথাকথিত পরকীয়া প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দিকে এগিয়েও সামাজিক কাঠামোর খোলসটাতে আটকে গিয়েছে বারবার। অস্বচ্ছতা বাসা বাঁধছিল ওই আটকে যাওয়াকে ঘিরেই। নারী স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা সংক্রান্ত আধুনিকবোধ ধাক্কা খাচ্ছিল ওখানেই। সুপ্রিম কোর্টের রায় সামাজিক কাঠামোর সেই খোলসটাকেই এ বার অবৈধ করে তুলল। অস্বচ্ছতার অবকাশটাকে লহমায় অনেকখানি লঘু করে দিল।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় যে ঐতিহাসিক, তা আরও একবার বলতেই হচ্ছে। ভারতীয় সমাজ যে সম্পর্কের বিন্যাসগুলোর প্রশ্নেও সাবালক হচ্ছে, তাও স্বীকার করতেই হচ্ছে। সম্পর্ক স্থাপনের আদি প্রহরটায় সম্পর্কের অভ্যন্তরীণ সাম্যের ছবিটা আদম-ইভ আখ্যানের মতো ছিল বলে যদি ধরে নেওয়া যায়, তাহলে আজ মানতে হবে যে, সেই প্রহরের সাম্যে ও স্বচ্ছতায় কিছুটা উপনীত হওয়ার একটা পথ সুপ্রিম কোর্ট খুলে দিল। মাঝের সুদীর্ঘ যাত্রাপথটায় জুটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত মুখোশ ও খোলসগুলো বর্জিত হল। সামাজিক ও যৌন সম্পর্কের ইতিহাসে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল সেখানেই। আবার বলি, এ দেশের সমাজকে এ দেশের বিচার বিভাগ এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে পৌঁছে দিল।