স্বপনদুয়ার খোলার শব্দ... এসো, বিচারের বাণী!

দীর্ঘ আন্দোলন আর প্রতীক্ষার পর উত্তরবঙ্গ পেল হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ। স্বপ্নপূরণের উচ্ছ্বাসের কথা লিখছেন শৈবাল বসুদীর্ঘ আন্দোলন আর প্রতীক্ষার পর উত্তরবঙ্গ পেল হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ। স্বপ্নপূরণের উচ্ছ্বাসের কথা লিখছেন শৈবাল বসু

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯ ০৬:২২
Share:

ম্যায় ঠিক হুঁ।’’ নীরবতা। ‘‘ম্যায় আচ্ছি হুঁ...।’’ ফোনের প্রান্ত থেকে ভীরু হরিণীর মতো মেয়েটির স্বর ভেসে আসে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল, তাকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হচ্ছিল কথাগুলো। চিরকালি যেমন হয়।

Advertisement

সনিয়া ওঁরাও। জলপাইগুড়ি জেলারি কোনও এক বন্ধ চা-বাগানে বড় হয়ে ওঠা মেয়ে। একমাস ধরে নিখোঁজ। ‘‘ও ভাল নেই শৈবাল! ও ভাল নেই! আমাকে কিছু একটা করতেই হবে...!’’এই কথাগুলো যেন নিজেকেই বলতে বলতে সদ্য জটিল অস্ত্রোপচারে টলোমলো কিন্তু প্রত্যয়ে দৃঢ় অর্পিতা একটা টোটো ধরবে বলে যখন এগিয়ে চলল আমার হাতে হাত রেখে, তখন মৌন মন্থরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে জলপাইগুড়িতে।

অনেক হারিয়ে যাওয়া মেয়ের চাপা স্বরের বাধ্য উচ্চারণের াবহের যখন সেই বহু-দেখা স্বপ্নের সত্যি হওয়াটা ঘটেই গেল আমাদের শহরে, মনে হল, এই তো সময় হাল না ছেড়ে দেওয়ার। কলকাতা হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ বহুকালের নিরাশারা নদী পার হয়ে এল অবশেষে, যেন প্রান্তর-প্রান্তের কোণের মানুষটির স্বর নিজস্ব আসনে বসে শুনতে এলেন স্বয়ং ‘ন্যায়’।

Advertisement

একটি হারানো মেয়ে এবং হাইকোর্ট— এর দূরত্ব কেবল সাড়ে ছ’শো কিলোমিটার নয়, সেটা জানি। এএই দূরত্ব অতিক্রমের পথ ও পন্থা যে খুব অারামের নয়, সেও তো জানা। তবু ভরসা জাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে, হাতের নাগালে একটা দরজা, দরজা নয় যেন, দুয়ার খুলছে! আর কেনই-বা উন্মীলিত হল হঠাৎই এই সত্যিটা যে, বহু উচ্চারিত, বহুল-উদ্ধৃতরবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ পঙ্‌ক্তিতে অপরাধী ‘শক্ত’ শব্দটি পুরুষ আর নীরবে নিভৃতে কেঁদে যাওয়া বিচারের ‘বাণী’টি নারী। বাংলা শব্দের লিঙ্গরূপকে চেতনে রেখেই ভেসে এল এই কথাটি।

অার এর সঙ্গেই মনে এল, ভারতীয় সংবিধানের পরতে পরতে উচ্চারিত সেই আশার বার্তাটি— বিচারের বাণী সকল দেশবাসীর জন্য সমান ভাবে উচ্চারণীয়। ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে ২০১৬ সালের ১৯ জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের এক ঐতিহাসিক রায়ের বয়ানে, যে রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ উচ্চারণ কের সেই অমোঘ সত্য যে, বিচারের দরজায় করাঘাত করার অধিকার ভারতীয় নাগরিকের নির্বিশেষ মৌলিক অধিকার। অজয়কুমার পাণ্ডে বনাম জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের এই মামলার (নং ১১৬/২০১১) এবং আরও একাধিক একই ধরনের মামলার মীমাংসায় এই সাংবিধানিক বেঞ্চ স্মরণ করিয়ে দেয় ভারতীয় সংবিধানের ১৪ এবং ২১ নম্বর ধারাকে, সংবিধান ব্যাখ্যাতার (জুডিশিয়াল রিভিউয়ার) অবিসংবাদিত ভূমিকাকে অবলম্বন করেই, এই বারতাখানি যে ভারতবাসীর জন্য অর্পিত মৌলিক অধিকারের বয়ানের শরীরেই আছে বিচারের বাণী শুনতে চাওয়ার অধিকার।

আজ মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৮৮ সালের এক বর্যাদিনের গভীর রাতে জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে সমস্ত অাসবাবপত্র যখন ট্রাকে করে নবাববাড়িতে নিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ল সেই হাতফোনবিহীন যুগেও, দলে দলে আিনজীবীরা জড়ো হলেন নবাববাড়ির গেটে, ট্রাক ঢুকতে বাধা দেবেন বলে। মধ্যরাতের সেই গহীন প্রতিরোধ এই আপাত-উদাসীন শান্ত জলপাইগুড়িবাসীর দুর্দম জেদের চেহারা নিলঅচিরেই। যেন আবহমানের অবহেলার ধুলো ধুয়ে নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল জলপাইগুড়ি।

একটি চিঠির কথা মনে আসে। ১৯৯০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীকে চিঠিটি লিখেছিলেন এ রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। চিঠির বক্তব্য ছিল, রাজ্য সরকার জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি শহরের তুলনামূলক আলোচনা করে মনে করছে যে, পরিকাঠামোগত কারণে সার্কিট বেঞ্চের স্থাপনায় জলপাইগুড়ি বেশি উপযুক্ত। পরের এক ২৯ নভেম্বর। খবরে প্রকাশ হল, রাজ্য সরকার শিলিগুড়িকেই বেছে নিতে চলেছে সেই আকাঙ্ক্ষিত বিচারভূমি হিসেবে। খবরটি পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের বয়ান হিসেবে প্রকাশ পেল সংবাদমাধ্যমে। তীব্র হল জলপাইগুড়ির মানুষের হতাশা আর অসম্মানের বোধ। হেলার সঙ্গে হীনবোধ জেগে উঠলে, দয়ার সঙ্গে দীনতার আঘাত ঘটলে যেমন ভিজে যায় নিজস্ব ঘরোয়া বিভেদগুলো, দ্রব হয়ে যায় দলীয়তার স্থানিক প্রাচীর, তেমনই মানুষ, জলপাইগুড়ির একেবারে সাধারণ মানুষ, দুঁদে আইনবিদ থেকে ফোটোকপির দোকান চালানো তরুণটিও জড়ো হলেন একই আশ্রয়ে। তৈরি হল ‘জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চ ও সার্বিক উন্নয়ন দাবি আদায় সমন্বয় কমিটি’।

পারস্পরিক ঈর্ষা ও প্রকাশ্য হিংস্রতার দিনেও সার্কিট বেঞ্চের দাবিতে যথার্থ অর্থে সত্যাগ্রহী হয়ে উঠলেন জলপাইগুড়ির মানুষ। সেই মাস্টারমশাইটি এগিয়ে এলেন, যাঁকে পেনশনের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টের দরজায় পৌঁছনোর সময় দালাল আর হোটেল-পরিচরে ত্রস্ত হয়ে, রিক্ত পকেটে ফিরে আসতে হয়েছিল। সেই সংখ্যালঘু মেয়েটি স্বপ্ন দেখল একটা ন্যূনতম সম্মানের। সে যে রচনা-বইয়ে পড়ে ফেলেছে শাহবানু মামলার কথা। সার্কিট বেঞ্চ যেন হয়ে উঠতে লাগল এক কোণঠাসা ধূসর জনপদের যাবৎ না পাওয়ার বিপরীতে ন্যায়ের প্রতীক। ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি যখন সীমায়িত হল জলপাইগুড়ির ৪০ একর মাটি, মানুষ স্বপ্নমাখা চোখে দল বেঁধে সেই মাটি দেখতে গেলেন শহরপ্রান্তে।

আশা আর নিরাশাকে, সম্ভাবনা আর সংশয়কে, েকত্রতা আর বিভানকে দু’পাশে রেখে বয়ে চলে করলা নদী জলপাইগুড়ির বুকের মাঝখান দিয়ে। তার শুকনো খাতে কখনও স্রোত আসে, কখনও শেষ-হেমন্তের শীর্ণ জলে ভেসে থাকে বিজয়ারসিঁদুর-মাটি গলে যাওযা দেবীপ্রতিমার কাঠামো। দিন যায়।

তারপর একদিন ২০১২-র ১ সেপ্টেম্বর, এক শারদদিনেই সার্কিট বেঞ্চের স্থায়ী ভবনের শিলান্যাস করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর আজ, অরণ্য-ছোঁয়া এই জনপদে তিনি এসেছেন, এসেছেন ন্যায়াধীশবৃন্দ। জরুরি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের একটি দুয়ার খুলছে আমাদের বাসভূমিতে।

সনিয়া ওরাওঁ, শুনতে পাচ্ছ দরজা খোলার শব্দ? চলো, যাওয়া যাক! সবাই আছে! আর আছে আমাদের সংবিধানের সেই অলঙ্ঘ্য ললাটলিপি— ‘উই দ্য পিপ্‌ল অব ইন্ডিয়া...টু সিকিওর টু অল ইটস সিটিজেন্স জাস্টিস...’!

এসো, বিচারের বাণী!

(লেখক জলপাইগুড়ির অরবিন্দ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন