জোড়াতালির ঐক্যও জরুরি

দ্রুত একটি ‘চতুর্থ মাত্রা’র নতুন শ্রেণি গড়ে উঠেছে। হিন্দু, মুসলমান সব সমাজেই। তথাকথিত উচ্চবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির বাইরে এই নতুন সমাজ। বিগত চার দশক ধরে রাজনীতির জলহাওয়া পেয়ে এদের বাড়বাড়ন্ত।

Advertisement

সৈয়দ আলাওল

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৭ ০৭:০০
Share:

সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনীতি শুধুমাত্র একটি দেশের বিষয় নয়। ছোঁয়াচে রোগের মতো এখন তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে। সমাজের উন্নয়ন, দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জাতির চরিত্র গঠন সব কিছুকে পিছনে ফেলে রাজনীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার মিশ্রণ ঘটিয়ে ভোটযুদ্ধে উতরে যাওয়াটাই এখন সব দেশের রাজনৈতিক দলগুলো রপ্ত করে ফেলেছে।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ-এর ‘এই তবে আমাদের ধর্ম,...’ (৯-৭) নিবন্ধে বিষয়টি আবার স্পষ্টতর হল: সত্যিই তো মার্কিন মুলুকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের নরেন্দ্র মোদী কিংবা পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ যেন এই দিক দিয়ে এক সুতোয় বাঁধা। সাম্প্রদায়িকতার চর্চা সমাজে ও রাষ্ট্রে আগে হয়নি এমন নয়। কিন্তু বিশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশক পর্যন্ত রুচিশীল, বিবেকবান বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে সেই ষড়যন্ত্র প্রতিহত হয়েছে বার বার। কিন্তু এখন— সামাজিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সংস্কৃতি যেন ভিন্ন মেরুর বিষয় হয়ে উঠেছে। ‘ধর্মীয় জীবন’ যাপনকারী কোনও ব্যক্তি, সে তিনি হিন্দু, মুসলিম যে ধর্মেরই সদস্য হন, বার বার উদারমনস্ক, রুচিশীল ব্যক্তিদের দিকে আঙুল তুলছেন। আঙুল তুলছেন ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’র দিকেও। প্রশ্ন উঠছে নাটক, কবিতা, গান নিয়েও। ধর্ম যখন হৃদয়ের বিষয় না হয়ে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে, তখনই এ রকম হয়। ত্যাগ, সংযম ও ভালবাসার বিপরীতে ভোগ, উন্মত্ততা ও ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারলেই ধর্মব্যবসায়ীদের লাভ। এদের প্রতিহত করার একমাত্র উপায় পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ভুলে উভয়ের ধর্মের সার অংশটুকু জেনে নেওয়া। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আমরা মঞ্চে এক কথা বলি, বাড়ি ফিরে যে যার মিথ্যে অন্ধবিশ্বাসে ফিরে যাই।

বিজ্ঞানের উন্নতি হলে, সমাজ শিক্ষিত হলে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, সাম্প্রদায়িকতা নিঃশেষিত হয়, এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান সময়ের শিক্ষা কেবল চাকরি পাওয়ার শিক্ষা। চাকরিটুকু পেলে সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে থাকব, দামি বাড়ি, দামি আসবাব, ছেলেমেয়ের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম, ব্যস অন্য কোনও ভাবনা নয়, শুধু ব্যক্তির নিজেরটুকু। আর এই সুখবোধের আনাচেকানাচে গড়ে উঠছে বিউটিপার্লার, শপিং মল, ফার্স্ট ফুড কর্নার। ভোগবাদী এই সমাজ আদর্শবাদের সব প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছে। শিক্ষা যেমন চাকরি পাবার মাধ্যম, ধর্ম তেমনই সামাজিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের সিঁড়ি। বর্তমান সময়ে ধর্মে ধর্মে পূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীলতা সম্ভব নয়। এখন জরুরি, কোনও ভাবে জোড়াতালি দিয়ে আপাত ঐক্য টিকিয়ে রাখা। না হলে একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে দাবানল ছড়িয়ে যেত না। আমরা-ওরার বিভাজন এত স্পষ্ট হয়ে উঠত না।

Advertisement

দ্রুত একটি ‘চতুর্থ মাত্রা’র নতুন শ্রেণি গড়ে উঠেছে। হিন্দু, মুসলমান সব সমাজেই। তথাকথিত উচ্চবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির বাইরে এই নতুন সমাজ। বিগত চার দশক ধরে রাজনীতির জলহাওয়া পেয়ে এদের বাড়বাড়ন্ত। অর্ধশিক্ষিত বা পুরো অশিক্ষিত এই সমাজাটই পার্টির প্রয়োজনে অস্ত্র সংগ্রহ করছে, ভোট লুঠ ও এলাকা দখল করে দলের প্রয়োজনীয় সম্পদ হয়ে উঠছে। চতুর্থ মাত্রার এই নতুন সমাজ আগে সিপিএম রাজনীতি করত। এখন তারা তৃণমূল রাজনীতি করে। বার্ধক্যভাতা, সরকারি অনুদান, বিভিন্ন প্রকল্পের টাকায় এরা লালিতপালিত হয়েছে চার দশক। এক দিন যা শিশু উদ্ভিদ ছিল, এখন ডালপালা মেলে বিষবৃক্ষ হয়ে পশ্চিমবঙ্গ গ্রাম-মফস্সল ছেয়ে গেছে। পুরনো দিনের অভাব, দারিদ্র মুছে সামান্য অর্থের মুখ দেখে নির্ভয়ে এরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজনীতির কুরুক্ষেত্র। আর যে ব্যক্তি যে ধর্মের সদস্য রাতের অন্ধকারে নিজ ধর্মের মৌলবাদের ভিত শক্ত করছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে না এলে এই শ্রেণিটিকে চিহ্নিত করা যাবে না। বিগত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে যে কয়েকটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, মালদহ, ইলামবাজার বা বসিরহাট, প্রত্যেক ক্ষেত্রে মাঠে নেমেছে নিম্ন আয়যুক্ত তথাকথিত অজ্ঞ সমাজ। যারা এই চতুর্থ মাত্রার সমাজের অংশবিশেষ।

প্রচুর ছেলেমেয়ে মাধ্যমিকে ভাল ফল করছে। নানাবিধ মিশন তাদের সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। স্বীকার করতে হবে শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা সাফল্য এসেছে। কিন্তু প্রদীপের নিচে যে অন্ধকার শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে যে বিপুল যুবসমাজ তার পরিমাপে না করার ফল এই নব্য ধারার সাম্প্রদায়িকতা। এখনই এ দিকে দৃষ্টি না দিলে ভবিষ্যতে অনুশোচনা করতে হবে।

রাজনীতির প্রয়োজনে যে অস্ত্র সংগৃহীত হয়েছে, তার পরিমাণ সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলি অন্ধকারে রয়েছে। রাজনীতির অস্ত্র ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ব্যবহৃত হবে না, এমন গ্যারান্টি কে দেবে! বিশেষ করে পার্টির সম্পদ নব্য ধারার এই শ্রেণিটির আর যা-ই থাক কোনও সাংস্কৃতিক চেতনা নেই। তাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল নেই, অমর্ত্য সেনের অসম্মানে তাদের কিছু যায় আসে না। ধর্মীয় সংযম, ত্যাগ, অন্যকে ভালবাসা, শ্রদ্ধা এ সব দূরের গ্রহ, ধর্ম বলতে এখন যা দাঁড়িয়েছে এক জন হিন্দুর ক্ষেত্রে মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখা, পুজো প্যান্ডালে আনন্দের, স্ফূর্তির উপকরণ খোঁজা। রাস্তা আটকে শুক্রবারের উপাসনা করে বুঝিয়ে দেওয়া এ সব সহ্য করতে হবে, নইলে ঝামেলা বেঁধে যাবে। প্রকাশ্যে গরু জবাই করে বুঝিয়ে দিতে হবে কার কত গায়ের জোর। সামান্য ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে লাগিয়ে দিতে হবে দাঙ্গা। এমন মাহেন্দ্রক্ষণেই তো রাজনীতি ঘোলা জলে মাছ ধরতে শুরু করে। ভোটের অংক, কোথায় ক’টি আসন, কোন সম্প্রদায়ের জোর বেশি, সে সব ভেবে পদক্ষেপ নেওয়া। তবে সে সব বলে কী লাভ। রাজনৈতিক দলগুলি কবে আর আত্মসমালোচনা করেছে। আগে উদ্ধৃত প্রবন্ধটি থেকে ধার করেই বলি, ‘আমরা সবাই জানি, আমি ও আমরা, যা বলছি, সেটাই সত্যি, আর অন্যরা যে যা বলছে, সব মিথ্যে।’

তবু বিশ্বাস করি, ট্রাম্প, মোদী, নওয়াজ শরিফদের জগতের বাইরে একটা জগৎ রয়েছে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জগৎ। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। বিভিন্ন বইমেলা, পির, সাধকের মেলায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে, লোকায়ত সংস্কৃতির আসরে এদের দেখা পাওয়া যায়। এখনও সবটা গলে পচে যায়নি। একটু সাবধানী হয়ে নজর রাখতে হবে। সমাজ ও প্রশাসনের চোখ খোলা থাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন