এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, অবশ্যই, রামচন্দ্র। মুশকিল হইল, গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটির নামে এত হাজার রকমের বিতর্ক থাকিলে রাজনীতি করিবার মহা অসুবিধা। অতএব রাজনীতির সিদ্ধান্ত: রামকে বাঁচাইবার জন্য যাবতীয় বিতর্ক দূর করিতে হইবে। রাম বিপন্মুক্ত হইলে তবেই রাম-সংস্কৃতির সমারোহ দেশময় ছড়াইয়া দেওয়া সম্ভব। ফলে, রামায়ণের সংশোধন চাই। আশ্চর্য, রামায়ণে রামের এত হাজার রকম কুকীর্তি লেখা! এত কিছু কুকীর্তি কেবল ঝগড়া করিয়া চাপা দেওয়া কি মুখের কথা? সংঘীয় প্রচারকদের ভারত-ইতিহাস লিখিবার সংগঠন অখিল ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনা তাই আগামী মাসে এক বিরাট ইতিহাস-সভার আয়োজন করিয়াছে। দেশের নানা প্রান্ত হইতে ‘ইতিহাসবিদ’রা আসিয়া সেখানে আলোচনা করিবেন রামকে বাঁচাইবার জন্য রামায়ণের কোন কোন অংশ কত দূর সংশোধন ও বর্জন করা প্রয়োজন। ‘ইতিহাসবিদ’দের পক্ষে কঠিন কাজ বটে। সংস্কৃত কাব্যসাহিত্য পড়িয়া প্রতিটি শ্লোকের মর্মোদ্ধার, সময়োদ্ধার এবং উদ্দেশ্য উদ্ধার করিয়া আজিকার রামভক্তদের অভিরুচি অনুযায়ী কাটাছেঁড়া করিয়া রামকে প্রতিষ্ঠা করা মুখের কথা নয়। বিশেষত যখন রামায়ণ-মতে, ‘পরমপুরুষ’ রাম নাকি সীতাকে বনবাস হইতে অগ্নিপরীক্ষা, ভয়ানক সব শাস্তির মুখোমুখি করিয়াছেন, বানররাজ বালিকে অন্যায় যুদ্ধে বধ করিয়াছেন। এই সবই আসলে অপপ্রচার। রামের চরিত্র রামভক্তরা যতটা জানেন, রামায়ণ কি তাহার অপেক্ষা বেশি জানে? কোন সাহসে রামায়ণের মধ্যে এই সব কাহিনি প্রবিষ্ট করানো হইয়াছে? কত দিন ধরিয়া অহিন্দুত্ববাদীরা এমন সক্রিয় প্রচারে লিপ্ত হইয়াছেন?
যোজনা যে সব ‘ইতিহাসবিদ’দের আহ্বান করিতেছে, তাহারা অবশ্যই এ সকল প্রশ্নেরই সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারিবেন। এবং একেবারে নিশ্চিত ভাবে স্থির করিয়া ফেলিতে পারিবেন, উত্তরকাণ্ডে সীতার অগ্নিপরীক্ষা আছে, সুতরাং তাহা প্রক্ষিপ্ত, সুতরাং এখনই বর্জনীয়। যুক্তিধারাটি যে এমনই হইবে— তাহা ইতিমধ্যেই ঘোষিত, অনুমানের স্থান নাই। যে যে স্থানে রামের প্রতি সংশয় জাগিতে পারে, রামায়ণের সেই অংশগুলিকে প্রক্ষিপ্ত বলিয়া মানিতে হইবে। আর, প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিকে বাদ দিলেই হাতে-গরম ঠিকঠাক রামায়ণ চমৎকার মিলিয়া যাইবে! বাস্তবিক, এতদিনকার হিন্দু শাস্ত্রকাররা বসিয়া বসিয়া কী করিতেছিলেন কে বলিবে। নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে আসীন না হইলে হিন্দু সভ্যতা এই ভুল রামায়ণের কবলে পড়িয়া আরও কয়েক শতাব্দী খাবি খাইত!
এত দিন যে সব দেশিবিদেশি গবেষক রামায়ণ লইয়া গবেষণা করিয়াছেন, তাঁহারা ভ্রুকুঞ্চিত প্রশ্ন করিতে পারেন, মূল রামায়ণ বলিয়া তো কিছু হয় না, ইহার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে মুখে মুখে রচিত। আলাদা করিয়া সে সব অংশের কাল ও স্থান নির্ধারণ তো অসম্ভব! ভাষাবিজ্ঞান দিয়া তাঁহারা যে কাজ করিতে পারেন নাই, আজ একটিমাত্র সভায় তাহার মীমাংসা হইয়া যাইবে? সীতার অগ্নিপরীক্ষা তো কেবল উত্তরকাণ্ডে নাই, আগেও আছে। তবে কি সেই অংশও প্রক্ষিপ্ত বলিয়া স্থির হইবে? অগ্নিপরীক্ষা বাদ দিলে লব-কুশও তো বাদ পড়িবেন, নাকি তাঁহাদের রাখিবার আলাদা ব্যবস্থা হইবে? সব প্রশ্নই বাতুলতা। যোজনার ইতিহাসবিদরা যাহা জানেন, গবেষকরা কি তাহার কানাকড়িও জানেন? বিদেশি গবেষকরা তো চির কালই উদ্দেশ্যপরায়ণ, হিন্দুসভ্যতার গৌরবহন্তারক। বিশ্বাস ও সংস্কারের কাছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ইতিহাস-সাহিত্য, সবই তুচ্ছ: এই গোড়ার কথাটি যোজনার ইতিহাসবিদরা শিখিয়াছেন, অন্যরা তো শিখেন নাই। তাহাই সত্য যাহা রচিবে রাজনীতি। রচনাকারই কেবল মৃত নয়, রচনাও মৃত। শাশ্বত কেবল, অভিসন্ধি।