Thangjam Manorama

কাকে বলে যুদ্ধ পরিস্থিতি?

মণিপুরের কাংলা দুর্গে অসম রাইফেলসের সদর দফতরের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সেখানকার জননীরা। তাঁদের দু’হাতে তুলে ধরা ফেস্টুনে লেখা ছিল: ‘‘ভারতীয় সেনা, এসো, আমাদের ধর্ষণ করো।’

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share:

ক্ষমা করতে পারবেন থাংজাম মনোরমা? ২০০৪-এর ১১ জুলাই অসম রাইফেলসের একদল জওয়ান মণিপুরে তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে তাঁর বুলেটবিদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। অভিযোগ ওঠে, তাঁকে প্রবল অত্যাচার করে ধর্ষণের পর গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে সে বছরের ১৫ জুলাই মণিপুরের কাংলা দুর্গে অসম রাইফেলসের সদর দফতরের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সেখানকার জননীরা। তাঁদের দু’হাতে তুলে ধরা ফেস্টুনে লেখা ছিল: ‘‘ভারতীয় সেনা, এসো, আমাদের ধর্ষণ করো।’’ গোটা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট বা আফস্পা) এবং উপদ্রুত এলাকা আইন (ডিস্টার্বড এরিয়া অ্যাক্ট) রদের দাবিতে উথালপাথাল মণিপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সংশোধন করে আফস্পাকে আরও মানবিক রূপ দেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, শান্তি ফিরলে এই আইন পাকাপাকি ভাবে তুলে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন তিনি। তার পরে ১৪ বছর কেটে গিয়েছে। এক জন অভিযুক্তকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি। আফস্পা-র বলে বলীয়ান সশস্ত্র বাহিনীকে কাঠগড়ায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে কে?

Advertisement

মণিপুরে ভুয়ো সংঘর্ষের ১৫২৮টি ঘটনার উল্লেখ করে ২০১৬-য় সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় এক্সট্রা জুডিশিয়াল এগজ়িকিউশন ভিক্টিম ফ্যামিলিজ় অ্যাসোসিয়েশন, মণিপুর (ইইভিএফএএম)। এই সংগঠনের সদস্যদের পরিবারের কেউ না কেউ ভুয়ো সংঘর্ষের শিকার। ২০১৬-র ৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট এই সব ঘটনার তদন্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয় এবং ২০১৭-র ১৪ জুলাই সিবিআইয়ের পাঁচ জন অফিসারকে নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গড়ে দেয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিরাও এই দলে আছেন। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট ১৫২৮টি ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনার মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে প্রথমে ৯৫টি ঘটনার তদন্ত করে চার্জশিট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এ বছরের জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে সরকার যে তালিকা পেশ করেছে তাতে রয়েছে ৪১টি ঘটনার কথা। সিট এবং মানবাধিকার কমিশনের কাছে বিচারপতি মদন বি লোকুর এবং বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতকে নিয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ প্রশ্ন তুলেছে, কয়েক মাসে ঘটনা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা কমে গেল কী করে? শুনানির সময় বিচারপতি লোকুর সরকার ও মানবাধিকার কমিশনকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, তারা যেন এই মামলাকে ‘সম্মান’ ও অগ্রাধিকার দেয়। তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা নিছক আরও একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছি না। আমরা মৃত্যুর কথা বলছি, যা খুনও হতে পারে।’’

আবেদনকারীরা ‘ঘরপোড়া গরু’, তাঁরা বারে বারে সরকারি তদন্তের ধরনধারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনার সময় প্রথমে যে এফআইআর হয়েছিল, তাতে অভিযুক্ত মণিপুর পুলিশ, অসম রাইফেলস বা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নাম থাকলেও পরে আদালতের নির্দেশে যে এফআইআর করা হচ্ছে, তাতে ‘আননোন পারসনস’ বা ‘অজানা ব্যক্তি’র কথা বলা হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তিকেই অভিযুক্ত হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

Advertisement

মস্ত গোলমালটা এখানেই। ১৯৫৮ সাল থেকে মণিপুর সমেত দেশের বিভিন্ন জায়গায় বলবৎ রয়েছে আফস্পা। সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলায় যে আইন আনা হয়েছিল, সেই আইনের শিকার এখন আমজনতা। মুশকিলটা হল, দেশের যে প্রান্তের আমজনতা এই আইনের শিকার, তাঁদের সঙ্গে ‘মূল ভারত’-এর আমজনতার অমিল বিস্তর। নির্বাচিত সরকারকে ‘সাহায্য করার জন্য’ সেখানে সেনা ও আধা সেনাবাহিনী বসে রয়েছে দশকের পর দশক। তারা নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অসামরিক সরকারকে সাহায্য করবে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যে ‘শান্তি’ ফেরাতে হলে সেনার যে আইনি ঢাল প্রয়োজন, কেন্দ্রীয় সরকারই তাদের সেই ঢাল দিয়ে দিয়েছে।

দিল্লির কর্তাদের মনোভাবটা অবশ্য সব যুগেই কার্যত এক। মণিপুরে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগটা ওঠেনি? ভুয়ো সংঘর্ষ, বলপূর্বক অপহরণ, ধর্ষণ— যে অভিযোগই উঠুক, কেন্দ্রীয় সরকার সাফাই দিয়েছে: ওখানে ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ চলছে। ‘যুদ্ধ’ই বটে! মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শত্রু নিধনের জন্য। অতি গুরুতর পরিস্থিতি ছাড়া অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষায় সেনা নামালে এবং তার উপস্থিতি স্থায়ী হয়ে গেলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে স্থানীয় মানুষজনের উপরেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যা পরিস্থিতিতে সেনা নামানো আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা নামানোর মধ্যে ফারাকটা বিস্তর।

আফস্পা-র মতো ভয়ঙ্কর আইন প্রত্যাহারের জন্য দেশ জুড়ে যত প্রতিবাদই সংগঠিত হোক না কেন, এখন পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। বিশেষ করে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে উগ্র দেশাত্মবোধ পরিণতি পাচ্ছে নির্বিচার নিধনযজ্ঞে। তা সে গরুপাচারের অভিযোগেই হোক বা শিশুচুরির গুজব।

কে বলবে, গত কয়েক দশকে এতগুলি হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ ও যথার্থ তদন্ত গণতন্ত্রের পক্ষেই শুভ। তা গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষেও মঙ্গলজনক। কাশ্মীরের মতোই উত্তর-পূর্বের জঙ্গি সমস্যাকে দেখতে হবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। শুরু করতে হবে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার প্রয়াস।

মনে করানো যাক সশস্ত্র বাহিনী (অসম ও মণিপুর) বিশেষ ক্ষমতা বিল নিয়ে ১৯৫৮-র ১১ থেকে ২২ অগস্ট সংসদে তীব্র বিতর্কের কথা। সেখানেই আউটার মণিপুর (জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত) আসনের কংগ্রেস সাংসদ রাংসাং সুইসা বলেছিলেন, ‘‘মণিপুরের পরিস্থিতি কি সে রকমই যেখানে এই অর্ডিন্যান্স প্রয়োজন? সরকার কি মনে করে যে এই অর্ডিন্যান্স সমস্যার সমাধান করতে পারবে?... এই সমস্ত অর্ডিন্যান্স ও সশস্ত্র বাহিনী পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং এটা আরও তিক্ততা ও ক্ষতিই বাড়াবে।’’ তাঁর গভীর এবং তীক্ষ্ণ মন্তব্য ছিল, ‘‘মানবাত্মার আর্তির তীব্রতা অনুভব করার সামর্থ্য সেনাদের নেই।’’

এত বছর পরেও এ কথা কি প্রাসঙ্গিক নয়? এই যেখানে সরকারের মনোভাব সেখানে অভিযুক্ত উর্দিধারীদের কাঠগড়ায় আনা যাবে কত দিনে? আদৌ যাবে তো?

‘এক দেশ এক আইন’-এর কথা যাঁরা উচ্চকণ্ঠে বলে থাকেন, সেই তাঁরাই কি মণিপুরে এসে এ কথা বলতে পারবেন?

ক্ষমা করুন থাংজাম মনোরমা! আপনার ধর্ষক ও হত্যাকারীদের বিচারের বাণী শোনানোর ক্ষমতা এই গণতন্ত্রের আদৌ আছে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন