ছবি: সংগৃহীত।
নকল হতে সাবধান—এই বাক্যবন্ধ আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত, কারণ এ দেশের বিপুল বাজারে আসলে-নকলে গলাগলি অবস্থান সারাক্ষণের। তাই কারবারিদের সাড়ম্বরে ঘোষণা করতেই হয় যে, গলাগলি অবস্থান যতই হোক, আসল-নকল কিন্তু এক নয়, ভেদ যথেষ্টই রয়েছে, সে ভেদ চিনে নেওয়াও জরুরি। বলে রাখা ভাল, সভ্যতর দেশে কিন্তু এই বাণী লেখার বা ঘটা করে ঘোষণা করার দরকার পড়ে না। আইনই সে ব্যবস্থা করে নেয়, তাই ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের পরিকল্পনা করতে হয় না সে পরিসরে। অন্তত প্রকাশ্য বাজারের বিকিকিনির ক্ষেত্রে তো বটেই।
এ দেশে কিন্তু এ বার বিকিকিনির আরও এক অভিনব রূপ খুঁজে পাওয়া গেল। বিকিকিনি না বলি, কারবার তো বলতেই হবে তাকে। সে কারবার নতুন নয় মোটেই, বহু বহু বছরের পুরনো সে। তবে জনপরিসরের বৃদহংশেই তার পরিচিতি কারবার হিসেবে নয়, পরিচিতি তার আধ্যাত্মিকতার মোড়কে। সেই আধ্যাত্মিক কারবারের স্বঘোষিত ঠিকাদাররা এ বার সতর্ক করলেন— নকল সাধু হতে সাবধান। অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদ ঘোষণা করল, ‘আসল সাধু’দের পরিচয় পত্র দেওয়া হবে। ভণ্ড কারা, তার তালিকাও তৈরি করল পরিষদ।
সাধু এবং বাবা এবং বাপুদের নানা ঘৃণ্য কারবারে দেশজুড়ে অনাস্থা এবং বিভ্রান্তির বাতাবরণটা এত বেড়ে উঠেছে দিনে দিনে যে, বিশ্বাসের কাঠামোটাকে দাঁড় করিয়ে রাখার কোনও না কোনও উপায় বার করতে হতই। ‘আসলে-নকলে’ যে ভেদাভেদ রয়েছে, তা ডেকে-হেঁকে না বললে এত দিনের নিশ্চিন্ত এবং নিশ্চিত আস্থার পরিবেশে অনর্থক ব্যতিব্যস্ততা তৈরি হওয়ার কারণ থেকে যায় কিছু। অতএব আখড়া পরিষদকে সিদ্ধান্ত নিতে হল, আসল সাধুদের পরিচয়পত্র দেওয়া হবে এ বার থেকে।
অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদ এই পরিচয়পত্র দেওয়ার কে? কী যোগ্যতা তাদের রয়েছে? ‘সাধু’ শংসাপত্র দেওয়ার প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠান এই পরিষদই, তা কে ঠিক করে দিয়েছে? এমন অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু সে সব প্রশ্ন না হয় তোলা থাক এখন। তার আগে দৃশ্যটা কল্পনা করা যাক। অগণিত ভক্ত ধেয়ে চলেছেন গুরুর আশ্রমের দিকে। আশ্রমে পৌঁছে তাঁরা আগে দেখে নিচ্ছেন, এ সাধু পরিচয়পত্র সম্বলিত সাধু কি না। আগমার্কা সাধু হলেই প্রণিপাত, আর শংসাপত্র না দেখতে পেলেই মুণ্ডপাত। এই রকমই কি হয়ে উঠতে চলেছে দৃশ্যপটটা?
শুধু পরিচয়পত্রের উদ্ভাবনেই অবশ্য শেষ হচ্ছে না আধ্যাত্মিক কারবারের অভিনবত্ব। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদ আবার অনেক ‘সাধু’কে নাকি কালো তালিকাভুক্তও করেছে। সে তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে, তাঁরা কিন্তু আইনের চোখে এবং জনপরিসরে ইতিমধ্যেই কালিমালিপ্ত। ভেজাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন যাঁরা, সেই গুরমিত-আসারাম-নারায়ণ-রামপালদের নতুন করে কালো তালিকায় ফেলে পরিষদ কী প্রমাণ করতে চাইল, সে প্রশ্নও আপাতত তোলা থাক। কারণ সাধুকুলে এই অভিনব তৎপরতা আপাতত বেশ ঔৎসুক্যই জাগাচ্ছে জনমনে।
এই দেশের বিরাট পটভূমিতে নানান পেশার নানান স্তরের মানুষই কিন্তু কালিমালিপ্ত হন নানা সময়ে। শুধু স্বঘোষিত সাধুদের গায়ে কালি লাগে, এমনটা নয়। মন্ত্রী-আমলার গায়ে, রাজনীতিক-সমাজসেবীর গায়ে, বিদ্বৎ-সুশীলের গায়ে— কালি নানা পরিসরের মানুষের গায়েই লাগে। ধরা যাক, রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেও এক দিন চালু হয়ে গেল এই আসল-নকল বা খাঁটি-ভেজালের ভেদাভেদ, তাঁদের জন্যও চালু হল শংসাপত্র, এই রকম কোনও এক পরিষদই হয়তো শংসাপত্র দেওয়া শুরু করল। কেমন হবে দেশের ছবিটা সে দিন?
প্রশ্নটা রঙ্গ-রসিকতার ঢঙেই ধরা দিল হয়তো। কিন্তু তেমন দিনও যে অচিরেই দেখতে হতে পারে, সে নিয়ে বিস্তর সংশয় পুষে রাখা উচিত নয়। সমাজ বা রাষ্ট্রের যে সব ক্ষেত্র কারবার না হওয়া সত্ত্বেও কারবারে পরিণত হয়েছে আজ, সেই সব ক’টি ক্ষেত্রই একে একে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কটে পড়বে। সাধু-সন্তদের নিয়ে আজ যেমন আস্থা-অনাস্থার মধ্যে দুলছেন সাধারণ মানুষ, রাজনীতিকদের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নেও হয়তো মানুষ এক দিন সে ভাবেই দুলবেন। বিশ্বাসের ভিতটাকে ধরে রাখতে তখন নানান কলা এবং কৌশলের পথই নিতে হবে, যে পথ আজ নিতে হচ্ছে অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদকে।
প্রশ্ন জাগে একটাই— চালে কাঁকর মিশে থাকার মতোই যে ভাবে গোটা ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চারিয়ে গিয়েছে আসল-নকলের মিশ্রণ, তাতে শংসাপত্র প্রদানকারীকেই বা বিশ্বাস করা যাবে কী ভাবে? শংসাপত্রের নামে দুর্নীতিও তো নানান স্তরে দেখেছে এবং দেখছে এ দেশ। আসল-নকল চিহ্নিতকরণের অছিলায় আরও একটা দুর্নীতির পথ যদি খোলে? ঠগ বাছতে তখন গোটা গ্রামই উজাড় হয়ে যাবে যে!
অভিনব পথে হাঁটার চেষ্টা ভাল। কিন্তু যে পথ ধরল আখড়া পরিষদ, সে পথও যদি আবর্জনার স্তূপের দিকেই এগোয় কোনও এক অমোঘ আকর্ষণে, তা হলে কিন্তু বড় ভয়ঙ্কর দিন আমাদের অপেক্ষায়।