কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অনশনকারী পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র।
একটি ভদ্রস্থ হস্টেলে মাথা গুঁজিবার ঠাঁই পাইতে দুই সপ্তাহ অনশন করিতে হইল মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের। কর্তৃপক্ষ জানাইয়াছেন, আপাতত নূতন হস্টেলে ব্যবস্থা হইতেছে। সরকারি পূর্ত বিভাগকে তাঁহারা জানাইয়াছেন, নূতন হস্টেল নির্মাণের কাজ অতি দ্রুত শেষ করিতে হইবে, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সংস্কার হইবে পুরাতন হস্টেলগুলিরও। ইহা তো ‘রুটিন’ কাজ, ইহার জন্য দুই সপ্তাহের অনশন প্রয়োজন হইল? ইহার পরও কি কলেজ পরিচালক শিক্ষকরা দাবি করিতে পারিবেন, ছাত্ররা তাঁহাদের সন্তানতুল্য? ছাত্রদের নিকট হইতে অভিভাবকের শ্রদ্ধা প্রত্যাশা করিতে পারিবেন? কর্তারা নাকি বলিয়াছিলেন, কোনও চাপের মুখে তাঁহারা নতিস্বীকার করিবেন না। যে রাজ্যের সেরা মেডিক্যাল কলেজে কুকুরের ডায়ালিসিস-এর পরামর্শ দেওয়া হয়, যে রাজ্যে চার আনার ছাত্রনেতারাও কলেজের অধ্যক্ষকে নির্দ্বিধায় ধমকাইয়া যায়, সেখানে এমন উক্তি অ-বিশ্বাস্য। অনশনরত ছাত্রদের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি রাজ্যবাসীকে গভীর উদ্বেগে রাখিয়াছিল। কিন্তু সেই উদ্বেগের লেশমাত্র কলেজ কর্তৃপক্ষের আচরণে দেখা যায় নাই। শাসক দলের চিকিৎসক-নেতারা নাকি শুরুতেই রাজনীতির রং বাছিয়া ফেলিয়াছিলেন এবং স্থির করিয়াছিলেন, অনশনরত ছাত্রদের দাবিতে কর্ণপাত করা চলিবে না। সেই পরাক্রমী নেতৃত্বকে টপকাইয়া মানবিক হইবার সাহস কলেজ কর্তৃপক্ষ দেখাইতে পারেন নাই। এই রটনা কতটা সত্য, তাহা লইয়া সচেতন রাজ্যবাসীর সম্ভবত বিশেষ সংশয় নাই। কিন্তু সত্যের শতাংশ যাহাই হউক, পরবর্তী দুই সপ্তাহ কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ যাহার সাক্ষী থাকিল, তাহা শুধু অসংবেদনশীল, অনৈতিকই নহে, অমানবিক।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বিধানসভায় জানাইয়াছেন, হস্টেলের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন কলেজের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তাহাতে সরকারের কোনও বক্তব্য বা কর্তব্য থাকিতে পারে না। যদি তাহাই হয়, তবে কথাটি কলেজ কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার জানা উচিত ছিল। দৃশ্যত, তাঁহারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সম্মতিভিন্ন শ্বাসটুকু লইতেও ভয় পাইতেছিলেন। ভয় অমূলক নহে। রাজ্যের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়ে সরকারের, বিশেষত শিক্ষামন্ত্রীর, এত বক্তব্য থাকে যে মেডিক্যাল কলেজ ব্যতিক্রমী হইবে, তাহা ভাবা মুশকিল। মেডিক্যাল কলেজেও রাজ্য সরকার বিলক্ষণ টাকা দেয়। ফলে, এই কলেজটি যে মন্ত্রিবরের জমিদারির অন্তর্গত নহে, সেই গূঢ় তথ্যটি কলেজের অধ্যক্ষ জানিবেন কী করিয়া? কলেজ কর্তৃপক্ষ শুধু সরকারের ভয়ে অমানবিক হইয়াছিলেন এমন দাবি করা কঠিন, কিন্তু সে ভয় যে নেহাত কম নহে, তাহা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ জানিবেন।
ছাত্রদের দুই সপ্তাহব্যাপী অনশন— যাহাতে জীবনহানির সম্ভাবনা ক্রমে বাড়িতেছিল— তাহাকে ‘কলেজের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলিয়া ছাড়িয়া দেওয়াও সরকারের কাজ হইতে পারে না। প্রশ্ন যেখানে বেশ কয়েকটি প্রাণের, সেখানে সমস্যা মিটাইতে সরকার দ্রুত সদর্থক পদক্ষেপ করিবে, এমন আশা অন্যায্য নহে। রাজ্য সরকার করে নাই। কেন, তাহার কারণটি আন্দাজ করা যাইতে পারে। যাদবপুরে যেমন হইয়াছিল, মেডিক্যাল কলেজেও কর্তারা একটি অকিঞ্চিৎকর প্রশ্নকে সম্পূর্ণ জেদাজেদির জায়গায় লইয়া গেলেন। প্রশ্নটি যে জয়পরাজয়ের নহে— বস্তুত, কতিপয় ছাত্রের সহিত যে সরকারের এ হেন কোনও যুদ্ধ হইতেই পারে না— পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই কথাটি বেমালুম ভুলিয়া গেল। অনুমান করা চলে, স্বেচ্ছায়। সব প্রশ্নকেই রাজনীতির রঙে দেখিবার, এবং সেই রাজনৈতিক যুদ্ধে জয়ী হওয়াকেই একমাত্র কর্তব্য ভাবিবার দাম্ভিক অপমানসিকতা আরও এক বার বলিয়া দিল, এই সরকারের রাজধর্ম অভ্যাস হয় নাই।