বিরোধিতা গণতন্ত্রে অপরিহার্য, ভুলে যাচ্ছি কি আমরা?

সরকার বা শাসকের সমালোচনা হলেই, সমালোচকের গায়ে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দেগে দেওয়ার অভ্যাস বেশ প্রাচীন। আমাদের দেশেও সে অভ্যাস বহু দিনের।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৬:০৪
Share:

সরকার বা শাসকের সমালোচনা হলেই, সমালোচকের গায়ে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দেগে দেওয়ার অভ্যাস বেশ প্রাচীন। আমাদের দেশেও সে অভ্যাস বহু দিনের। কোনও মন্তব্যে বা প্রতিবাদে যদি অস্বস্তি হয় শাসক দলের বা সরকারের নীতি নির্ধারকদের, তা হলেই সে প্রতিবাদকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহমূলক বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা ভারতে অতীতে বহু বার দেখা গিয়েছে। সম্প্রতি সে প্রবণতা আরও একটু বেশি বলে প্রতীত হয়। এই বদভ্যাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সরকারের সমালোচনা মাত্রেই রাষ্ট্রদ্রোহ নয়— আরও এক বার স্পষ্ট করে জানাল সুপ্রিম কোর্ট। যে সন্ধিক্ষণে ভারত দাঁড়িয়ে আজ, তাতে খুব জরুরি ছিল এই বার্তার উচ্চারণ।

Advertisement

এমন উচ্চারণ যে দেশে এই প্রথম, তা কিন্তু নয়। গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে পরিচিত যে প্রতিষ্ঠানগুলি, তারা বার বার ক্ষমতাসীনের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সংস্থান যে চিরন্তন, সে মূল্যবোধ এ দেশে যথেষ্ট মজবুত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। তার মধ্যেও কিন্তু বার বার বিরোধী স্বরের বিনাশাকাঙ্খা মাথাচাড়া দিয়েছে।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কখনও বিরোধী স্বরের বিনাশ চায় না, সংরক্ষণই চায়। বিরোধীর শিবিরে যত ক্ষণ বেঁচে থাকে নির্ভীক সমালোচনার অধিকারবোধ, তত ক্ষণই গণতন্ত্রের আয়ুষ্কাল। যে নাগরিক চিন্তার রাজ্যে ক্ষমতাসীনের বিপরীত মেরুতে, তাঁর অধিকারের মৃত্যু আসলে গণতান্ত্রিক চেতনার মৃত্যু। এই বোধ ভারতীয়ত্বে যথেষ্টই বিদ্যমান। কিন্তু রাজনৈতিক দাপটেও এক অনাকাঙ্খিত শ্লাঘার নিহিতি রয়েছে। দাপট দেখিয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে নুইয়ে দেওয়ার মধ্যে প্রভুত্ব আস্বাদনের আহ্লাদ রয়েছে। উপমহাদেশের অন্যান্য রাজত্বেও এই প্রবণতার উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করেছি। তাতে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কী ভাবে বার বার ধাক্কা খেয়েছে, তাও আমরা দেখেছি। তা সত্ত্বেও সতর্ক হতে পারিনি অনেকেই।

Advertisement

ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের পারিপার্শ্বিকতায় অগণতান্ত্রিক মরুবালুরাশি। মাঝে ভারত গণতন্ত্রের সযত্নলালিত মরূদ্যান এক। গৌরবের মহিমান্বিত অস্তিত্ব সেই সত্যেই নিহিত। ভুলে যাচ্ছিলাম আমরা সে কথা। সকলে না ভুললেও অনেকেই। দেশের সর্বোচ্চ আদালত আরও এক বার মনে করিয়ে দিল। আরও এক বার স্পষ্ট বাখ্যায় জানিয়ে দিল, প্রতিবাদ, বিরোধিতা, সমালোচনা গণতন্ত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।

১৯৬২ সালেও এমনই সতর্কবার্তা শোনা গিয়েছিল বিচারবিভাগের সর্বোচ্চ পীঠস্থানটি থেকে। ক্ষমতার অলিন্দে নতুন যে প্রজন্মের অধিষ্ঠান আজ, পাঁচ দশকেরও বেশি আগে ধ্বনিত সতর্কবার্তার অনুরণন সে প্রজন্মের কর্ণকুহরে নেই হয়তো আর। তাই আরও এক বার মনে করিয়ে দিতে হল কথাটা। আরও এক বার ধরিয়ে দিতে হল গণতন্ত্রের মূল সুরটা। মরূদ্যানের গরিমা নিয়ে বাঁচতে চাইলে, এই উচ্চারণের অনুরণনটা চিরন্তন করে নিতে হবে আমাদেরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন