চমকে উঠেছিলেন সম্পাদক

‘সওগাত’-এর উদারপন্থী ও স্বাধীন চিন্তাভাবনায় বাড়তি প্রেরণা জোগালেন কাজী নজরুল ইসলাম। করাচির উনপঞ্চাশ নম্বর সেনা ছাউনি থেকে পাঠানো ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’ প্রথম বর্ষ সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যা কবির প্রথম মুদ্রিত রচনা।

Advertisement

নাসিম-এ-আলম

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন

১৯১৮-র শীতে ভেজা ডিসেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সওগাত’ পত্রিকা, সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন (ছবিতে)। ‘সওগাত’ তুর্কি শব্দ, বাংলা অর্থ উপহার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তাঁর স্বপ্ন ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভাবনার প্রসার ঘটানো। বিমা কোম্পানির কাজের সূত্রে ‘সওগাত’ প্রকাশের এক বছর আগে ১৯১৭-য় কলকাতায় আসেন তিনি, কোম্পানির কাজে বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাসিরউদ্দিন উপলব্ধি করেন, শিক্ষা ছাড়া দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না; সমাজের উন্নয়ন ঘটবে না। ‘সওগাত’ প্রকাশের ঠিক আগে প্রকাশিত ‘মিহির’, ‘কোহিনুর’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘নবযুগ’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকারও উদ্দেশ্য ছিল নিজের সমাজের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনার প্রসার। যদিও ‘সওগাত’ যতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল, অন্যগুলি ঠিক ততখানি অর্জন করতে পারেনি। সমাজের জাগরণ ও প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যে হেতু ‘সওগাত’-এর আত্মপ্রকাশ, অতএব পত্রিকার প্রকাশ-লগ্নে সম্পাদক কয়েকটি নীতি নির্ধারণ করেছিলেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের ভাষার ‘সওগাত’-এর সপ্তনীতি। সপ্তনীতির দিকে চোখ রাখলে ‘সওগাত’ প্রকাশের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়— ১) লেখকগণের স্বাধীনতা প্রকাশের সুযোগ দেওয়া, এবং মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তাসমৃদ্ধ রচনাকে অগ্রাধিকার দান করা ২) প্রথম শ্রেণির মাসিকের আদর্শে প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, উপন্যাস প্রভৃতি দ্বারা পত্রিকার অঙ্গসৌষ্ঠব বৃদ্ধি করা ৩) সমাজের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করা ৪) পত্রিকার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সচিত্র প্রবন্ধ এবং মুসলিম জগতের সচিত্র বিবরণ নিয়মিত প্রকাশ করা ৫) নারীশিক্ষা ও নারী জাগরণমূলক প্রবন্ধাদি ও ‘চিত্রে মহিলা জগৎ’ প্রকাশ করা, মহিলাদের সাহিত্য সাধনায় উৎসাহিত করা ৬) সাহিত্যিক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তরুণ লেখকের লেখা প্রকাশ করে তাদের উৎসাহিত করা, এবং সব শেষে ৭) একটি নির্ভীক ও নিরপেক্ষ সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করা।

Advertisement

‘সওগাত’-এর উদারপন্থী ও স্বাধীন চিন্তাভাবনায় বাড়তি প্রেরণা জোগালেন কাজী নজরুল ইসলাম। করাচির উনপঞ্চাশ নম্বর সেনা ছাউনি থেকে পাঠানো ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’ প্রথম বর্ষ সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যা কবির প্রথম মুদ্রিত রচনা। পরে নজরুলের মোট আশিটি রচনা ‘সওগাত’-এ প্রকাশিত হয়। করাচি থেকে কলকাতায় এসে ‘সওগাত’-এর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেন নজরুল। ‘সওগাত’-এর অফিসে সৈনিকের পোশাকেই সাক্ষাৎ করতে আসেন। চমকে ওঠেন সম্পাদক। নজরুল হেসে নিজের পরিচয় দেন। সম্পাদককে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘‘আমি কাজী নজরুল ইসলাম, বাঙালি পল্টন ভেঙে দিয়েছে তাই করাচি ছেড়ে চলে এলাম, আপনি সওগাতে আমার প্রথম লেখা ছেপেছেন সে কথা ভুলিনি, সকলের আগে আপনার সঙ্গেই দেখা করতে ইচ্ছে হল।’’ নজরুল যেমন ‘সওগাত’-এর মুখ্য লেখক হয়ে ওঠেন, তেমনি কবির জীবন ও লেখনী সম্পর্কে ‘সওগাত’-এ নানা সংখ্যায় আলোচনা প্রকাশিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে ১৩৩৪-১৩৩৬ বঙ্গাব্দে এখানেই প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯১৮ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত দীর্ঘ তিন দশকে ‘সওগাত’-এ প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য লেখকের রচনা প্রকাশিত হয়েছে। ‘সওগাত’ সম্পাদকের আহ্বান ফেরাননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিভিন্ন সংখ্যায় লিখেছেন প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, সরলাবালা সরকার, নন্দলাল বসু, এস ওয়াজেদ আলি, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন, জলধর সেন, দিলীপকুমার রায়, জীবনানন্দ দাশ, সুকুমার সেন, জসীমউদ্দিন, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী আব্দুল ওদুদ, সুফিয়া কামাল, ইসমাইল হোসেন সিরাজি, আবদুল কাদির-সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন