বন্ধুত্ব: ঘনশ্যামদাস বিড়লা ও মহাত্মা গাঁধী। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিনিয়োগকারীদের অবদান নিয়ে ইতিহাসবিদরা বহু আলোচনা করেছেন
বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করেছিলেন, ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস নাই।’ গত রবিবার লখনউয়ে বিনিয়োগকারীদের সম্মেলন দেখে বুঝলাম, আসমুদ্রহিমাচল এই দেশের প্রধানমন্ত্রীরও ইতিহাস নাই। নইলে বিতর্কিত শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছবি তোলার কথায় আচমকা মহাত্মা গাঁধীকে টেনে আনেন, ‘‘গাঁধীর উদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল বলেই বিড়লাদের বাড়িতে থাকতেও দ্বিধা করেননি।’’
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তো এটুকু জানা উচিত, শুধু বিড়লা কেন, টাটা থেকে বাজাজ, সারাভাই অনেক শিল্পপতিরই আতিথ্য গ্রহণ করেছেন গাঁধী। ওয়ার্ধায় গাঁধী আশ্রমের জমিটি শিল্পপতি জমনালাল বাজাজের দেওয়া। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময়েই গাঁধী জানিয়েছেন, ‘‘স্যর রতন টাটার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে, আমাদের সত্যাগ্রহে উনি ২৫ হাজার টাকা দান করেছেন।’’
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সবে ফিরেছেন গাঁধী, তখনও দেশ জুড়ে নাম ছড়ায়নি। সাবরমতীতে তাঁর আশ্রমে রোল্স রয়েস চেপে হাজির আমদাবাদের অন্যতম মিল-মালিক অম্বালাল সারাভাই। গাঁধীর হাতে টাকা ভর্তি ব্যাগ তুলে দিয়ে বলেছেন, ‘‘শুনেছি, আশ্রমে আর্থিক অনটন চলছে। এটি উপহার হিসাবে গ্রহণ করুন, আমার নাম জানাবেন না।’’ গাঁধী কিন্তু অম্বালালের কথা বারংবার বলেছেন। হিসেব দিয়েছেন। ভবিষ্যতে অম্বালালের বোন অনসূয়াবেনই তো গাঁধীর সঙ্গে বসে আমদাবাদে টেক্সটাইল শ্রমিকদের প্রথম ইউনিয়ন তৈরি করবেন। পরাধীন ভারতে এই শিল্পপতিরা ব্যাঙ্কের টাকা তছনছ করে বিদেশে পালানোর জন্য আদৌ নেতাদের কাছে ঘুরঘুর করতেন না।
গাঁধীর নাম টানার আগে প্রধানমন্ত্রীর আর একটি ব্যাপার জানা জরুরি ছিল। গাঁধী শুধু শিল্পপতিদের বাড়িতেই আতিথ্য নিতেন না। সতীশ দাশগুপ্ত তখন ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’-এর প্রধান রসায়নবিদের চাকরি ছেড়ে খদ্দর ধরেছেন। তাঁর সোদপুরের বাড়িতে বারংবার এসেছেন গাঁধী, সেখানে এখন ‘গাঁধী আশ্রম’। আশ্রমে রূপান্তরিত বেলেঘাটার আলোছায়া সিনেমার কাছে যে বাড়িতে তিনি এসেছিলেন, সেটিও। উত্তরাখণ্ডের কৌশানিতে এক বাড়িতে বসে গাঁধী গীতার ‘অনাসক্তি যোগ’ নিয়ে লিখেছিলেন, সেটিও এখন অনাসক্তি আশ্রম। ১৯৪৭-এর দাঙ্গার সময় গাঁধী নোয়াখালিতে হেমন্তকুমার ঘোষের বাড়িতে ছিলেন। সেই বাড়িটি এখন ‘গাঁধী আশ্রম ট্রাস্ট’। শুধু দিল্লির ‘বিড়লা হাউস’ নয়, গাঁধী যেখানে উঠতেন, সেখানকার লোকেরা বহু আগেই ‘গাঁধী আশ্রম’ নামে সে সব বাড়ি উৎসর্গ করেছেন। ভূপর্যটক প্রধানমন্ত্রী নিজের দেশটাই তা হলে চেনেন না?
প্রধানমন্ত্রীর মনোবিশ্লেষণেও আমরা ঢুকব না। গাঁধী বললেই সেই অনুষঙ্গে তাঁর অবচেতনে বিড়লাদের বাড়ি, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮, নাথুরাম গডসে ইত্যাদি হানা দেয় কি না সেই আলোচনা মনোবিশ্লেষকদের একান্ত বিষয়। কিন্তু ঘনশ্যামদাস বিড়লা কি শুধুই পুঁজিপতি? তিনি ‘হরিজন সেবক সঙ্ঘ’র দায়িত্বশীল সভাপতি। গাঁধীর সম্পাদিত ‘হরিজন’ কাগজটি চলে তাঁরই টাকায়। ১৯৩৩-এর ২১ মার্চ গাঁধীকে বিড়লার চিঠি, ‘‘গত কয়েক বছরে কলকাতার ৬৬০টি বস্তির মধ্যে ২০০টি-র হাল ফেরাতে আমরা সক্ষম হয়েছি। বাকি ৪৪০টি সেই তিমিরেই। ভেবেছিলাম, এ ব্যাপারে লোকে সোৎসাহে এগিয়ে আসবে, কিন্তু পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি তুলতে পারলাম না।’’ তিন বছর বাদেও এ নিয়ে প্যাশন কমেনি। গাঁধীর সচিব মহাদেব দেশাইকে লিখছেন, ‘‘পিলানিতে হরিজন হস্টেল ভালই এগিয়ে চলছে। উঁচু ক্লাসের একটি ছেলেকে বর্ণহিন্দুদের জন্য তৈরি বড় হস্টেলে রাখা হয়েছে। সেই বর্ণহিন্দুরা বিন্দুমাত্র আপত্তি তোলেনি।’’ মোদী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের কথা বরং থাক।
জি ডি বিড়লার তৈরি পিলানির সেই স্কুল, কলেজ, হস্টেল আজকের মোদী জমানাতেও শিক্ষার অন্যতম উৎকর্ষকেন্দ্র— বিড়লা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স। প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানেন, এর সঙ্গে তাঁর বন্ধু শিল্পপতির অস্তিত্বহীন বিশ্ববিদ্যালয় তথা উৎকর্ষকেন্দ্রের তুলনা চলে না।
গাঁধী-ঘনিষ্ঠ ঘনশ্যামদাস বিড়লাকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে, মেহুল চোক্সী বা নীরব মোদীরা অলঙ্কার-ব্যবসায়ী মাত্র। শিল্পপতি নন। ঘনশ্যামদাস বিড়লা সেখানেই আলাদা। তাঁর ঠাকুরদা শিবনারায়ণ, বাবা বলদেওদাস দু’জনেই কাঁচা তুলো, চিনি, আফিম ইত্যাদির ব্যবসা করতেন। ঘনশ্যামদাস সেই ট্রেডিং থেকে বেরিয়ে এলেন। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তৈরি করেন চটকল। একে একে সুতো, চিনি, সাবান, কেমিক্যাল, বিমা, কাগজ। পরাধীন ভারতে সুতো এবং পাট এই দুই শিল্পক্ষেত্রে ব্রিটিশদের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে দেওয়াই ঘনশ্যামদাসের অন্যতম কৃতিত্ব। অতঃপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়েই বিড়লাদের সম্পদ ২০ লক্ষ থেকে বেড়ে হয় ৮০ লক্ষ। কালে কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই ব্যবসা-সাম্রাজ্যের পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা।
ঘনশ্যামদাস নিজেই লিখেছেন, তিনি গাঁধীজির পুত্রপ্রতিম। কিন্তু এ হেন পুত্রকেও গাঁধী অনেক বাধা দিয়েছেন। বাপুর প্রতি যাবতীয় শ্রদ্ধা সত্ত্বেও ঘনশ্যামদাস কখনও কংগ্রেস-সদস্য হননি। ১৯৩৭ সালে বিড়লা চাইছেন, ব্রিটিশ শিল্পপতিদের সঙ্গে ভারতীয় শিল্পপতিদের একটি বাণিজ্যচুক্তি হোক। গাঁধীর চিঠি, ‘‘এ জাতীয় বাণিজ্যচুক্তিতে আমার সমর্থন নেই। আমি মনে করি, রাজনৈতিক ইস্যু দূরে সরিয়ে কোনও বাণিজ্যচুক্তি হতে পারে না।’’
রাজনীতিক ও শিল্পপতির অসমবয়সি জটিল বন্ধুত্ব। সেখানে শ্রদ্ধা আছে, আছে ছোট ছোট স্বার্থের টানাপড়েনও। শ্রেণিস্বার্থের কথা কোনও দিন গোপন করেননি শিল্পপতি। তাঁর আশঙ্কা, সত্যাগ্রহ না থাকলে তরুণরা সকলে কমিউনিস্ট হয়ে যাবে। বাপুর পৃষ্ঠপোষক হয়েও কখনও কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে একমত হতে পারেননি, ‘‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস আর পূর্ণ স্বাধীনতার অহেতুক ফারাক টানা কেন, বুঝি না।’’ ১৯৪০ সালে লিখছেন, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে নিজেকে একাকার করে দিয়ে বাপু কিন্তু নিজের সঙ্গে বামপন্থীদের ফারাকটা প্রায় ঘুচিয়ে দিচ্ছেন। কংগ্রেসের নেতারা ওঁকে ব্যবহার করছে, তারা জানে, বাপু ছাড়া গণআন্দোলন কখনও সফল হবে না।’’ ব্রিটিশ ও গাঁধী দুইয়ের মাঝে তিনি অলিখিত দূত, আবার ব্রিটিশ শিল্পপতি ও ভারতীয় শিল্পপতিদের মধ্যে সেতু। গাঁধীর মতো তিনিও কোনও দিন স্বধর্মচ্যুত হননি। নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু দু’জনের সমাজতান্ত্রিক ঝোঁকই তাঁর অপছন্দ। আবার ১৯৩৯-এ মহাদেব দেশাইকে জানাচ্ছেন, ‘‘এম এন রায় বাংলার নেতৃত্ব নিতে সুভাষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টায় রত। সুভাষ বাপুর ওপর বিশ্বাস রাখে না, কিন্তু শ্রদ্ধা করে। এম এন রায় বাপুকে বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা কোনওটাই করেন না। তাই সুভাষকে সমর্থন করা যায়, রায়কে কদাপি নয়।’’
লুকোছাপার কিছু ছিল না। গাঁধী এবং বিড়লার চিঠিপত্র আগেই প্রকাশিত, ‘ইন দ্য শ্যাডো অব মহাত্মা’ নামে বিড়লার নিজের লেখা স্মৃতিকথাও আছে। ইতিহাসবিদরাও প্রচুর আলোচনা করেছেন। এ সব না জেনে গাঁধীও তো বিড়লার সঙ্গে থাকতেন জাতীয় আলটপকা কথা রকের আড্ডায় শোভা পায়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে নয়!