রাজকৌশল: ময়নাগড়ের রাজপ্রসাদ। নিজস্ব চিত্র
ঘরের উপরে ঘর। তার উপরে ঘর। সাধারণত তা-ই হয়। কিন্তু এই রাজপ্রাসাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টোদিক দিয়ে বলতে হবে। ঘরের নীচে ঘর। তার নীচে ঘর। এমন একখানা প্রাসাদ রাজপ্রাসাদের নীচেই রয়েছে। জানতেন না রাজপুরুষদের কেউ। সংস্কারের সময়ে জানা গেল প্রাসাদের নীচে আরেক প্রাসাদের অস্তিত্ব। পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নাগড় রাজপ্রাসাদের নানা বৈশিষ্ট্যের অন্যতম।
ময়নাগড় রাজবংশ একই সঙ্গে ইতিহাস, কিংবদন্তী আর মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তমলুক থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রাচীন রাজপরিবার সম্পর্কে আজও প্রচলিত প্রবাদের মতো ছড়া, ‘ময়না রাজার মান, গজনা রাজার ধান।\কুচল ঘোড়ই এর পাকা, দে নন্দের টাকা’। ময়নার রাজারা চিরকাল অভিজাত। এঁদেরই রাজধানী ময়নাগড়।
প্রথমে মঙ্গলকাব্যের যোগ। ময়নাগড় একসময়ে ধর্মমঙ্গলের বীর লাউসেনের রাজধানী ছিল। লাউসেনের সঙ্গে ইতিহাসেরও যোগ আছে। গৌড়েশ্বর ধর্মপালের সেনাপতি কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন। নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস গ্রন্থে’ এ প্রসঙ্গ লিখেছেন। আবার মঙ্গলকাব্য অনুসারে লাউসেনের সঙ্গে কিংবদন্তীরও যোগ রয়েছে। ধর্মঠাকুরের কৃপায় পশ্চিমঘাটে সূর্যোদয় দেখিয়েছিলেন লাউসেন। তবে লাউসেনের পর পরিত্যক্ত এই গড় জলদস্যু শ্রীধর হুইয়ের দখলে যায়। উৎকল অধিপতি কপিলেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে তাঁর সামন্তরাজ কালিন্দীরাম সামন্ত কেলেঘাই তীরে বালিসিতাগড়ে রাজত্ব করতেন। তাঁরই পঞ্চম পুরুষ গোবর্ধনানন্দ শ্রীধর হুইকে হটিয়ে ময়নাগড় অধিকার করে। তিনিই ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে রাজপরিবার প্রতিষ্ঠা করেন। গোবর্ধন সামন্ত উৎকলরাজ মুকুন্দ হরিচন্দনের সময় বালিসিতা গড়ে বাসকালে কর দান বন্ধ করলে উৎকলরাজ যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু গোবর্ধন পরাজিত ও বন্দি হন। রাজপ্রাসাদের অদূরে বন্দিশালা। রাজা ও রানি বন্দি গোবর্ধনের সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে এই বীর যোদ্ধাকে সিংহাসন, রাজছত্র চামর, বাণ, ডঙ্কা ও যজ্ঞউপবীত রাজচিহ্ন এবং বাহুবলীন্দ্র উপাধি দেন।
এখন ময়নাগড়ে গোবর্ধনানন্দের প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। তা থেকে কিছুটা অনুমান করা যায় মাত্র। এই প্রাচীন প্রাসাদ বৌদ্ধ স্থাপত্যের সঙ্গে ওড়িশি শিল্পকলার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল। ছিল খিলান ও গম্বুজময়। বর্তমানে রাজবাড়ির যে প্রাসাদটি দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে তার নির্মাণে বিদেশি রীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। রোমান পদ্ধতিতে তৈরি। প্রবেশদ্বারে থাম এবং ছাদের বৈশিষ্ট্যে বিদেশি ছাপ বোঝা যায়। মাঝে ভিতর বারান্দা-সহ চারদিক ঘিরে দ্বিতল বৃহৎ অট্টালিকার তিনদিকের কক্ষগুলো তালা লাগানো। প্রবেশের অযোগ্য, ধ্বংসপ্রায়। প্রাসাদের একদিকে রাজা প্রণবানন্দ বাহুবলীন্দ্রের বাসস্থান। পূর্বদিকের দরবার কক্ষে এখনও সভাসমাবেশ, সাহিত্য সম্মেলন বসে। এই প্রাসাদ সংস্কারের সময় এর নীচে আরও একটি প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া যায়। অনুমান, বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার প্রাসাদটি পুনর্নির্মিত হয়েছে। এরই ঈশাণ কোণের প্রথম তলের একটি কক্ষ এখনও রহস্যময় প্রত্নসম্পদে পূর্ণ। বাইরে থেকে কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙেই প্রাসাদের দরবার কক্ষে পোঁছনো যায়। তাই ভিতরে প্রবেশ না করলে এটি যে দ্বিতল প্রাসাদ বোঝাই যায় না।
গোবর্ধনানন্দ ময়নাগড় জলদস্যুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বসবাস করতে প্রাসাদ পুনর্নির্মাণ করেন। সেই সময়ে ময়নাগড়ের ভিতর অংশের বাইরের চারদিকে দ্বিস্তর গভীর পরিখা খনন করেন। পরিখা দু’টি কালিদহ, মাকড়দহ নামে পরিচিত। এখনও কালো জলে ভরা। গড় সংলগ্ন কালিদহ ৭৫০ ফুট বা ৫৬২৫০০০ বর্গফিট। এখনও নৌকায় পরিখা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। মাকড়দহের ভিতর প্রতি পাশে ১৪০০ ফিট। দু’টি পরিখা ধরে সমস্ত গড়ের পরিমাণ ১৯৬০০০০ বর্গফিট বা ৩০৭ বিঘা। গড়ের মধ্যে পনেরো শতাব্দীতে নির্মিত শ্যামসুন্দর জীউয়ের মন্দির এবং ষোলো শতাব্দীর লোকেশ্বরের মন্দির রয়েছে। জাগ্রত দেবতা লোকেশ্বর গর্ভগৃহে। মন্দিরে পাথরের প্রাচীন বৌদ্ধদেবী রঙ্কিণীর মূর্তি এখনও দেখা যায়। এটি সম্ভবত লাউসেন প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের গায়ে ষোড়শো শতাব্দীর টেরাকোটার কাজ অক্ষত রয়েছে। কালিদহ, মাকড়দহের মধ্যে দশম শতাব্দীর বৌদ্ধ পীঠস্থন রয়েছে। দুই পরিখার বাইরে রাসমঞ্চ। এখানে প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে রাস উৎসব হয়। হিন্দু মুসলমান ভক্তরা প্রতি বছর রাস আয়োজন করেন। গড়ের পূর্বে বৈষ্ণব মহান্ত নয়নানন্দের সমাধি। উত্তরে কালিদহের তীরে পির হজরত তুর জালাল শাহের দরগা। এই গড় হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের মিলনক্ষেত্র।
গোবর্ধনানন্দের পর দশ পুরুষ প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করেন। জগদানন্দের রাজত্বকালে (১৭৭০-৭৩ খ্রিস্টাব্দ) ময়নারাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়। জগদানন্দের সঙ্গে কোম্পানির লড়াইয়ের সময়ে লেফটেন্যান্ট রবার্ট বেইলির নেতৃত্বে ইংরেজ সেনা প্রাসাদ আক্রমণ করে। কিন্তু প্রাসাদে রাজার হদিশ পায়নি ইংরেজ সেনা। সম্ভবত সুড়ঙ্গপথে রাজা অন্যত্র চলে যান। বর্তমানে সেই সুড়ঙ্গটি চুন সুরকি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রাজা গোবর্ধনানন্দের পর তাঁর পুত্র পরমানন্দ ভূস্বামী হন। তিনি পরমানন্দপুর গ্রাম পত্তন করেন। এই গ্রামে শ্রীকৃষ্ণরায় জীউর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে নিষ্কর ভূমি দান করেন। মুঘলরাজ জাহাঙ্গির পরমানন্দকে বাদশাহি প্রতীক পাঞ্জা প্রদান করেন। তাঁর পুত্র মাধবানন্দের রাজত্বকালে বাংলা শায়েস্তা খাঁয়ের অধীনে যায়। এই এলাকা একসময়ে সমুদ্র তীরবর্তী ছিলে বলে মনে করা হয়। বাহুবলীন্দ্র রাজারা সমুদ্র তীর থেকে জেগে ওঠা ১০৫টি গ্রাম নিয়ে ময়না পরগণা গঠন করেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় জগদানন্দ ময়নার রাজা ছিলেন। তাঁর পুত্র ব্রজানন্দের সময় হেস্টিংস পাঁচসালা ও কর্ণওয়ালিস দশসালা ব্যবস্থা করেন। ১৭৯১ সালে ময়না পরগনার খাজনা বাকি পড়ে। দেড় টাকা অনাদায়ে তার সমান মূল্যের জমি নিলাম হবে বলে ঘোষিত হয়। ব্রজানন্দের মৃত্যুর পর ময়না পরগনা ছোট ছোট জমিদারিতে ভাগ হয়ে যায়। রাজা পূর্ণানন্দ বাহুবলীন্দ্রের রাজত্বকালে (১৮৬৩-১৯৩৭) অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ময়নাতেও তার প্রভাব পড়ে। রাজা নিজে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ময়না সেবক সম্মিলনী গঠিত হয়। গড়ের মধ্যেই ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয়। যেটি পরে পেডি স্মারক বিদ্যাপীঠ এবং বর্তমানে পূর্ণানন্দ বিদ্যাপীঠ নামে পরিচিত। হেরম্বানন্দের সময় রাজপরিবার শরিকে ভাগ হয়ে যায়।
ময়নাগড়কে হেরিটেজ স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পূর্ণিমার রাতে কালো জলে ভরা পরিখা ঘেরা গড়ের সৌন্দর্য রোমাঞ্চকর। এই সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে সত্যজিৎ রায় ১৯৭১ সালে এসেছিলেন। সোনার কেল্লার শ্যুটিং করার জন্য। ছবি বিশ্বাস বারবার রাজ পরিবারের আতিথ্য গ্রহণ করতেন। এখানে সারা বছর বহু মানুষ আসেন রাজপরিবার ও গড়ের টানে। দ্বিতীয় পরিখা মাকড়দহের ওপর দিয়ে গিয়েছে ময়না-খড়্গপুর উড়ালপুল।
লাউসেন, জলদস্যু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস নিয়ে ময়নাগড় এখনও সাক্ষী-গড় হয়ে বর্তমান।
লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক