কীর্ণাহারে দেবনাথ দাসের মূর্তি । ছবি: কল্যাণ আচার্য
বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের এক শীতের দুপুর। এক ভদ্রমহিলা সঙ্গে আরও তিন-চার জন কীর্ণাহারের দাস পরিবারের বাড়ির কাছে এসে জানতে চাইলেন চিত্ত রায়ের বাড়িটা কোথায়। এক কিশোর জানলায় মুখ বাড়িয়ে অপলক চেয়ে দেখছে অচেনাদের। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে পরিচয় জানতে চাইলে ভদ্রমহিলা বললেন, আমি দেবনাথ দাসের মেয়ে, জার্মানি থেকে আসছি। জানলার সেই কিশোর বনমালী রায়ের কাছে দেবনাথ দাস, আজাদ হিন্দ বাহিনী, স্বাধীনতা সংগ্রাম— এক লহমায় যেন আলোর ঝলকানির মতো খেলা করে গেল ।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সুভাষচন্দ্র বসুর অকৃত্রিম সহযোগী দেবনাথ দাসের জন্ম ১৯০৪ সালের ২১ জানুয়ারি। বাবা উপেন্দ্রলাল দাস, মা পরমেশ্বরী দেবী। জমিদার পরিবারের সন্তান অথচ দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করেছে। উপেন্দ্রলালের সংগ্রহে বাংলার রেনেসাঁ যুগের বইপত্র ছিল। নিজে ভাল সংস্কৃত জানতেন। দিনে দিনে একটা লাইব্রেরি গড়ে উঠল। এ রকম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পড়াশোনোর শুরু দেবনাথের। কীর্ণাহার শিবচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের পরে যাদবপুর ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনে। স্বদেশি যুগে দেশে-বিদেশে এই প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ছিল। এই কলেজই পরবর্তী কালে হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। দেবনাথ দাস এএমআইই ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন।
স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব তখন দেশ জুড়ে। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেওয়ার ডাকে বাংলার গ্রামে গ্রামে সাড়া পড়ে গিয়েছে। দেবনাথও স্বদেশি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হন। বিশ শতকের তিরিশের দশকে কখনও কলকাতা, কখনও বিদেশ থেকে ফিরে কীর্নাহারের পাড়ায় পাড়ায় খদ্দরের জামা কাপড় বিক্রি করতেন দেবনাথ। ভোরে পাড়ার ছেলেদের ডেকে নজরুলের গান শেখাতেন –‘‘চল চল চল / ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল...,’’। সেই গান আর দেবনাথ দাসের বক্তৃতা রক্তে তুফান তুলত যুব সমাজের মনে। এরই মাঝে তদানীন্তন বর্মার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি করেছেন। রাঁচী আর বর্মায় ওদের রঙের খনি ছিল। দেবনাথ নানা কাজের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে ভালবাসতেন। আর অন্তরে সুভাষচন্দ্রের দেশ ভাবনা ক্রিয়াশীল থাকত। পরে জাপানে গিয়ে ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরির কোম্পানিতে যোগ দিয়েছেন। বিস্ময়কর তথ্য, এটা জাপানের একটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবাদী চরিত্র হিসাবে ছাত্র জীবনেই একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নেতাজীর সহযোগী হিসাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক বিশাল কর্মযজ্ঞে সামিল হতে পারবেন কীর্ণাহারের দেবনাথ দাস, এটা প্রথমে কেউই ভাবতে পারেনি। সে সময়ের কীর্ণাহার শিবচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশুতোষ রায় চৌধুরী এবং সামশুদ্দিন আহমেদ দেবনাথের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সামশুদ্দিন আহমেদ ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল হালিমের দাদা। কীর্ণাহার ও লাভপুর এলাকা সে সময়ে কৃষি আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান ছিল। কীর্ণাহারের নিকটবর্তী ঠিবার রাধানাথ চট্টরাজ, সরডাঙ্গার আব্দুল হালিম, মিরাটির কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাবা) নানা ভাবে নানা অভিমুখে কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অভিমুখ ও বিস্তার বিষয়ে দেবনাথ দাসের সুচিন্তিত অভিমত ছিল। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে আধাত্ম্য চেতনার যোগও প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যা এ দেশের মাটির ভিতর থেকে নির্মিত। ‘নেতাজীর অভ্যুত্থান’ প্রবন্ধে তাঁর অভিমত, “প্রথম যখন ভারতবর্ষ পরাধীন হত তখন ইংরেজ সর্বপ্রথম চেষ্টা করেছিল ভারতের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক চিন্তা ধারাকে খর্ব করতে। ইংরেজ চেয়েছিল ভারতবাসী যেন ইংল্যান্ডকে আধ্যাত্মিক গৃহ হিসাবে গণ্য করে, যাতে ভারতের সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রগতি ব্যাহত হয়। কিন্তু রাজা রামমোহন রায়ের অভ্যুদয়ে এবং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের তপস্যায় ও সাধনায় ভারতবাসী তার গৌরবময় অতীতকে জানবার জন্য সচেষ্ট হল এবং সঙ্গে সঙ্গে অতীতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ধর্মের সঙ্গে আধুনিক জগতের সভ্যতার মিলন ভূমিকে ভারতবাসী গড়ে তুলল। এই হল ভারতের মুক্তি স্বাধীনতার প্রথম সোপান।” এর পরে বাহাদুর শাহ ও ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈ-এর সংগ্রামকে তিনি ‘নবচেতনার উন্মেষ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। পরে সেই আন্দোলনকে ঝড়ের গতি দান করেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী এবং নেতাজী। স্বাধীনতা সংগ্রামী দেবনাথ দাসের ভাষায়, ‘‘যারা ছিলেন কাপুরুষ, পঙ্গু এবং মরণের পথে যাবার জন্য ভয় করতেন, তাঁরা ভয় শূন্য হলেন এবং বাংলার বিপ্লবের অবদান সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যে সেই বিপ্লবী আত্মার প্রতিষ্ঠা হল। বিপ্লবের পথের উপকরণও ভারতের গৃহে গৃহে সংগৃহীত হলো।’’
দেবনাথ দাস যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন, এখানেই শেষ নয় নিজের গ্রামে অর্থাৎ কীর্ণাহারে ১৯৩৬-এ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তরুণ সমিতি। যার লোগো তিনি নিজে তৈরি করে এনেছিলেন লাহোর থেকে। জাপানে রাসবিহারী বসু প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ। প্রথমে এর সদর দফতর ছিল টোকিও। পরে স্থানান্তরিত হয় ব্যাংককে। সভাপতি রাসবিহারী আর সম্পাদক দেবনাথ দাস। নেতাজীকে সিঙ্গাপুর হয়ে প্রথম পর্বে জার্মানি আসতে বলা হয়। এর পরবর্তী ইতিহাস অর্থাৎ সংগঠিত আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে নানা পথ অতিক্রম করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত সগৌরব উপস্থিতি ইতিহাস জানে। দীর্ঘ এই লড়াইয়ে দেবনাথ দাস সব সময় সুভাষচন্দ্র বসুর পাশে থেকেছেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিপর্যয়ের পরে দেবনাথ দাস ধরা পড়েছেন। জনতার প্রবল প্রতিরোধে মুক্তি পাওয়ার পরে পাঁচ ও ছয়ের দশকে বেশ কয়েক বার কীর্ণাহার আসেন। পাঁচের দশকে কীর্ণাহার উত্তরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাঁর হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার কথা এখনও ভোলেননি আজকের বর্ষীয়ান, সেদিনের জানলায় মুখ বাড়িয়ে থাকা কিশোর বনমালী রায়। দেবনাথ দাস এসে পাড়ায় ঘুরতেন, আড্ডা দিতেন প্রিয় মানুষদের সঙ্গে। স্বাধীনতার ঠিক পরে কীর্ণাহারের লক্ষ্মীতলায় দেবনাথ দাসকে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কীর্ণাহার ও পার্শ্ববর্তী প্রায় সব গ্রামের মানুষ সমবেত হয়ে দেশাত্মবোধক গান, আবৃত্তি পরিবেশন করেন। নিমড়ার মনোয়ারা বেগম, যাঁর বয়স এখন নব্বইয়ের কাছাকাছি, তিনিও নজরুল ইসলামের একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। দিব্যি স্মৃতিচারণা করলেন সে-সব দিনের।
১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময় নোয়াখালি থেকে অজস্র শরণার্থী শুধু দেবনাথ দাস এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর উপরে ভরসা রেখে কীর্ণাহারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে ছিল দেবনাথ দাস প্রতিষ্ঠিত ‘তরুণ সমিতি’। ২০০৪ সালে কীর্ণাহার শিবচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুত্র দেবেশ কুমার দাস। তাঁর আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়েছে কীর্ণাহারে। রয়েছে দেবনাথ দাস সরণি। আর রয়েছে তাঁর স্মৃতি, যে স্মৃতির সরণি বয়ে পথ হাঁটেন এলাকার প্রবীণেরা।
(লেখক সাহিত্যকর্মী এবং সেচ দফতরে কর্মরত, মতামত নিজস্ব)