মনে হত, সত্যিই টিনটিন আছে

পেশায় স্থপতি। কিন্তু নেশা কার্টুন আঁকা। কার্টুনেই মহফুজ আলি বাংলায় নিয়ে এসেছেন টিনটিনকে। কখনও তার কীর্তিকলাপ কলকাতায়, কখনও দার্জিলিঙে। ফেসবুকে দেওয়া তাঁর সেই ছবি শেয়ার করেছে খোদ টিনটিনের দেশ বেলজিয়ামের দূতাবাস। মহফুজের সঙ্গে কথা বললেন সুজিষ্ণু মাহাতো একেবারে ছোটবেলায় থাকতেন মায়াপুরের কাছে নিদয়া গ্রামে। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন গ্রাম থেকেই। বেশ কিছু দিন সেখান থেকে, তারপর মামার বাড়ি ধুবুলিয়া থেকে যাতায়াত করতেন স্কুলে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:৩৯
Share:

অধুনা অস্ট্রেলিয়া-নিবাসী মহফুজ আলির মন জুড়ে এখনও রয়েছে কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। উচ্চ-মাধ্যমিকের পরে শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে। তার পর কলকাতা। সেখান থেকে দিল্লিতে চাকরি করে আপাতত অস্ট্রেলিয়ায়।

Advertisement

একেবারে ছোটবেলায় থাকতেন মায়াপুরের কাছে নিদয়া গ্রামে। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন গ্রাম থেকেই। বেশ কিছু দিন সেখান থেকে, তারপর মামার বাড়ি ধুবুলিয়া থেকে যাতায়াত করতেন স্কুলে। খুব মুশকিল হত সকালবেলা অত দূর থেকে যেতে। বলেন, ‘‘খুব চেষ্টা করে বাবা একটা ছোট কোয়ার্টার পেয়েছিল জোড়াকুঠি হাউজিংয়ে। আমার তখন ক্লাস টু। তখন থেকেই পাকাপাকি কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা।’’

স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে হাউজিংটা। যেটা ছিল শহর থেকে একটু দূরে। খুব সুন্দর ছিল জায়গাটা। কালেক্টরের মোড় পেরিয়ে জেলা পরিষদের অফিসের সামনে দিয়ে এসে হাইরোড পেরিয়ে। সামনে ছিল বড় পুকুর আর তার উপরে ট্রেনের লাইন। রাতে মালগাড়ি গেলে পুরো বিল্ডিং কাঁপত। কিন্তু ট্রেন দেখলেই ব্যালকনিতে গিয়ে হাত নাড়াটা কখনও ছাড়তে পারেননি।

Advertisement

কৃষ্ণনগরের ভাললাগার পুরোটাই জুড়ে আছে তাঁর স্কুল। বলছেন, ‘‘ওই অদ্ভুত সুন্দর লাল বাড়িটায় আমি এখনও বাড়ি গেলে এক বার না গিয়ে থাকতে পারি না। পিছনে একটা কদমগাছ ছিল। শেষ বার গিয়ে দেখি সেটা আর নেই। খুব খারাপ লেগেছিল। কত স্মৃতি ওই স্কুলে! আমাদের ফুটবল লিগ, উপরের কমনরুম, সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল সাজানো— কত কী!’’ গর্ব অনুভব করেন ওই স্কুলের ছাত্র হিসেবে। স্কুলের সিনিয়ররা মাঝে মাঝে এখনও যোগাযোগ করে কোনও কার্টুন ভাল লাগলে। অনেকে যোগাযোগ করেছে জার্মানি থেকে, আমেরিকা থেকে। সবাই ওই স্কুলের ছাত্র।

স্কুলের সঙ্গে সঙ্গেই এসেছিল অসাধারণ সব বন্ধু। মহফুজ বলেন, ‘‘বন্ধুভাগ্য চিরকালই ভাল আমার। বন্ধুরা বড্ড বেশি ভালবাসে আমায়। এটা আমি চিরকাল অনুভব করে এসেছি। তাই যেখানেই যাই কৃষ্ণনগরের উপরে টান থেকেই যায়।’’

তিনি জানালেন, আঁকার শুরুও ওই স্কুলেই। স্কুলের শিক্ষকেরাও ছিলেন খুব ভাল। উৎসাহ দিতেন।

মহফুজ বলেন, ‘‘আমাদের আঁকা শেখাতেন স্বপনবাবু, স্বপন বিশ্বাস। উনি ক্লাসে আঁকার সঙ্গে সঙ্গে ছবিতে রামায়ণ-মহাভারতের বই এনে সেগুলো পড়াতেন। আর মাঝে মাঝে হত গল্প বলার ক্লাস। বিক্রম অসাধারণ গল্প বলত। ‘ব্রাজিলের কালো বাঘ’ বোধ হয় ওর মুখেই শুনেছিলাম ক্লাসে বসে। তবে ওই সময়ে ভাল আঁকতে পারতাম না আমি। এখনও যে পারি, বলব না। একটা গল্প বলার চেষ্টা করি আঁকার মধ্যে।’’ জানান, তাঁর বন্ধুদের মধ্যে অনেকে খুবই ভাল আঁকেন। মহফুজের কার্টুন আঁকা ওই বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাসে বসেই শুরু হয়েছিল। বন্ধুদের, অনেক সময়ে শিক্ষকদের আঁকতেন। শিল্পী বলে চলেন, ‘‘টেনিদা ছিল প্রিয় চরিত্র। টেনিদার কমিক-স্ট্রিপ বানানোর চেষ্টা করতাম। বন্ধুদের জন্যই উৎসাহ পেয়েছি এটা চালিয়ে যাওয়ার।’’

তবে, টিনটিনের প্রতি ভালবাসাটা একেবারে ছোটবেলা থেকেই। মনে আছে, তাঁর বাবা আনন্দমেলা এনে দিয়েছিলেন। সেখানেই দু’পাতা টিনটিনের কমিকসের সঙ্গে প্রথম পরিচয়— ‘‘সেটা সম্ভবত ছিল ‘কৃষ্ণদীপের রহস্য’। টিনটিন আর কুট্টুস একটা দুর্গে বন্দি। তার পর থেকে টিনটিন নেশা হয়ে যায়। ছোটবেলাতেই বাড়ির একটা ভাঙা দেওয়ালে টিনটিনের ছবি আঁকার চেষ্টা করি। মনে আছে, হ্যারিকেনের আলোতেই ওই দু’পাতা বার বার পড়তাম আর পরের সংখ্যার অপেক্ষায় থাকতাম।’’

টিনটিনের কমিকসের সবচেয়ে কী ভাল লাগত তাঁর? উত্তরে শিল্পী সপ্রতিভ ভাবে বলেন, ‘‘আসলে টিনটিনের ছবিগুলো এত জীবন্ত ছিল যে ওগুলো যে কাল্পনিক, সেটা মনেই হত না। মনে হত সত্যিই টিনটিন আর কুট্টুস আছে। এত আপন মনে হওয়ার আরেকটা কারণ ছিল চমৎকার বাংলা অনুবাদ। এত স্বাভাবিক ছিল অনুবাদ, টিনটিনের চরিত্রদের কখনও অচেনা মনেই হয়নি।’’

মহফুজ তত দিনে ভূগোলে পড়ে ফেলেছেন ছোটনাগপুর মালভূমির কথা। সেই থেকে চেনা মনে হত, টিনটিনের কমিকসের বরডুরিয়া-সিলডাভিয়ার কথা।

‘‘আসলে তখনও তো ইন্টারনেট এখনকার মতো আসেনি। টিনটিনের কমিকস ছিল আমার কাছে, আমাদের সকলের কাছে বিশ্বের জানলা। হিমালয়ে অভিযান থেকে মরুভূমি, সমুদ্রে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়া থেকে চাঁদে যাওয়া— এ সবের ছবিই সে সময় আমরা প্রথম দেখতাম টিনটিনের কমিকসে।’’ এক নিশ্বাসে বলে ফেলেন মহফুজ। তাই টিনটিনের প্রভাবকে অস্বীকার করেন না।

সেখান থেকেই টিনটিনকে বাংলায় কল্পনা করে তাঁর ছবি। সে ছবি যে এতখানি জনপ্রিয় হবে, কখনও ভাবেননি মহফুজ। প্রাণের খেয়ালে শিল্পকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর পরিণতির কথা না ভেবেই।

মহফুজ বলেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরে আসলে এমনিই কলকাতায় টিনটিনকে এনে একটা ছবি এঁকেছিলাম। টিনটিনের ২০১৮-র ফেসবুকে সেটা শেয়ার করার পরে ওটা বেলজিয়ামের দূতাবাস শেয়ার করে। তার পর ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ও কয়েকটা এঁকেছিলাম। এ বছরও তাই দার্জিলিংয়ে টিনটিনকে কল্পনা করে একটা ছবি আঁকি। ওটা দিল্লির বেলজিয়াম দূতাবাস তো বটেই, বেলজিয়ামেও নাকি শেয়ার হয়েছে।’’ শুনে ভালই লেগেছিল। ইচ্ছে রয়েছে, আগামী দিনে টিনটিনকে বাংলার আরও নানা জায়গায় নিয়ে আসার। ইচ্ছে আছে, নিজের ছোটবেলার শহর কৃষ্ণনগরেও টিনটিনকে ঘোরানোর। বাস্তবে নয়, অবশ্যই তাঁর আঁকা ছবিতে!

কারণ, যতই হোক, অস্ট্রেলিয়াবাসী বাঙালি শিল্পীর মন তো পড়ে থাকে নিজের শহরেই। পড়ে থাকে পিছনে ফেলে আসা ছেলেবেলায়। সেই যে কৃষ্ণনগর মানেই সাইকেল চালিয়ে খড়ি নদীর ধার, ঘূর্ণীর পুতুলের দোকান আর সব চেয়ে প্রিয় কাজ ব্রিজের নীচে বসে ট্রেন দেখা।

মহফুজ বলেন, ‘‘মহালয়ার দিন আমাদের অলিখিত প্রথা ছিল সকাল সকাল ট্রেনের ব্রিজের নীচে কাশফুলের মধ্যে বসে ট্রেন দেখা। এখনও মহালয়ার দিনে যেই থাকুক কৃষ্ণনগরে, ব্রিজের নীচে একবার যাবেই। আমিও জানি, আমি যদি গিয়ে পৌঁছোই, কারও না কারও সঙ্গে দেখা হবেই।’’ আরেকটা জায়গা হল কলেজের মাঠ। বিরাট বড় মাঠ, যেখানে এক কোণায় ওঁরা খেলতেন।

‘‘পুরো মাঠ ভরে থাকত তখন। ছোট ছোট করে ভাগ করে নিয়ে কত লোক খেলত তখন। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফুটবল খেলতাম আমরা। যতদূর মনে পড়ে, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যেও আমরা ফুটবল খেলতে গিয়েছি কলেজের মাঠে।’’ ওখানে সেগুন গাছের তলায় সন্ধে না নামলে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করত না তাঁর।

শিল্পীসত্তা থেকে সরে আসা মানুষটির নিপাট বাঙালি সত্তাটি প্রকাশ পায়, যখন খাওয়ার গল্পে ঢুকে পড়েন। জানান, খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষ্ণনগররের জুড়ি মেলা ভার।

‘‘তখন বিরিয়ানি পাওয়া যেত না কৃষ্ণনগরে। কিন্তু যা পাওয়া যেত সেটাই অনেক। অদ্ভুত ভাল কচুরি-ডালপুরি-শিঙাড়া পাওয়া যায় কৃষ্ণনগরে। বেজিখালির ওখানে দোকানে তো শিঙাড়া হওয়ার পাঁচ মিনিটে শেষ হয়ে যায় এখনও। কৃষ্ণনগরের মিষ্টি তো বিখ্যাত। শহর ছাড়ার পর যেখানেই গিয়েছি, বাড়ি থেকে আনা সরভাজা-সরপুরিয়া খেয়ে সবাই অবাক হয়ে যেতেন।’’

শহর ছাড়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই ওই সব খাওয়া-দাওয়া কমেছে। ছেড়ে গিয়েছে কচুড়ি-ডালপুরি-শিঙারা। তবে পিছু ছাড়েনি আঁকা। সে কাজ এখনও চলছে।

মহফুজ বলেন, ‘‘দিল্লিতে যখন কাজ করতাম তখন অফিসে অনেকের জন্মদিনে, ফেয়ারওয়েলে এঁকেছি। তার পরে অস্ট্রেলিয়া আসার পরেও আঁকিবুঁকি চলছে। কৃষ্ণনগরে যখন থাকতাম তখন বৃষ্টি হলে খেলতে যাওয়া হত না। তখন বাড়িতে বসে ছবি আঁকতাম। এখনও তাই বৃষ্টি পড়লেই আঁকতে ইচ্ছে করে।’’

কৃষ্ণনগরকে মিস করেন দুর্গাপুজোর সময়টায়। দুর্গাপুজোর ওই ছুটি, ঢাকের শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা গান, কাশফুল— এগুলো ভুলতে পারেন না। কথায় কথায় জানালেন, এ বছর সিডনির দুর্গাপুজোয় গিয়েছিলেন।

‘‘ঢাক বাজছে, ভোগ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেই বন্ধুদের সঙ্গে পাত্রবাজারের আড্ডা নেই, বিজয়ার প্রণাম করে মিষ্টি খাওয়া নেই। তাই যেখানেই থাকি কৃষ্ণনগরকে মিস করি।’’ মিস করেন নিছক বাঙালিয়ানাকে।

সে সবই হয়তো অবচেতনে ছবি হয়ে বাংলায় টেনে আনে টিনটিনকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন