কাড়াখুঁটা: পুবের আঙিনায় পশ্চিমের উৎসব

পুরো সমাজ তাই এক দিকে আলো সাজায় দীপাবলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। হেমন্ত পূর্বজদের মাস, আকাশপ্রদীপের। সেই ছায়াপথ দিয়েই তো ভূতপ্রেতদেরও আনাগোনা। তাই ভূত চতুর্দশী, তাই আলো-উৎসব। লিখছেন জয়া মিত্রপুরুলিয়ায় দেখতাম, ভাইফোঁটার দিন দুপু্রবেলা এক পরব হত। তাকে বলত গরুখুঁটা। কোনও কোনও পাড়ায় কাড়াখুঁটাও বলা হত। কাড়া মানে মহিষ। দুপুর থেকেই দেখতাম, পাড়ার একটা ফাঁকা জায়গায় ছেলেবুড়ো জড়ো হতে শুরু করত। সঙ্গে কারও ঢোল, কারও কাঁসি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৮ ০২:২২
Share:

কাড়াখুঁটা উদ্‌যাপন। পুরুলিয়া পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের নাককাটা কালীমন্দির প্রাঙ্গণে। ছবি: সুজিত মাহাতো

দেবতারা সব আছে চেয়ে

Advertisement

জাগো ধরার ছেলেমেয়ে

আলোয় সাজাও ধরিত্রীরে

Advertisement

কালীপুজোর দু’দিন পরে ভাইফোঁটা।

পুরুলিয়ায় দেখতাম, ভাইফোঁটার দিন দুপু্রবেলা এক পরব হত। তাকে বলত গরুখুঁটা। কোনও কোনও পাড়ায় কাড়াখুঁটাও বলা হত। কাড়া মানে মহিষ। দুপুর থেকেই দেখতাম, পাড়ার একটা ফাঁকা জায়গায় ছেলেবুড়ো জড়ো হতে শুরু করত। সঙ্গে কারও ঢোল, কারও কাঁসি।

বেলা বাড়লে দেখা যেত একটা গরু, তার সারা গায়ে অনেক সজ্জা, মানে আলু কিংবা লাউ কেটে আলতায়, নীলে বা সবুজ রঙে চুবিয়ে তা দিয়ে গোল, বাঁকা নানা বিধ ছাপ দেওয়া। খুরের পাশে আলতা পরানো, শিং-এ তেল। গলায় বেলপাতা কিংবা গাঁদাফুলের মালা। তাকে এনে মাঠের একধারে একটা খুঁটিতে বেঁধে রাখা হত। দুপুর ঢলে পড়ার সময়ে ভিড় বাড়ত, গান আর কোলাহলও। এই কোলাহলে খুশির মেজাজ থাকত।

ঢোল, কাঁসি ছাড়াও, সম্মিলিত ঝুমুর গানের নানা কলি উঠতে থাকত নানা জনের গলায়। খুব কাছে যেতাম না, একটু দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম। কাছে না-যাওয়ার কারণ ছিল। এই সমস্ত হইচইটা চলত সেই ‘রূপসী’ গরুকে গোল করে ঘিরে। সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল বাড়ত। কেউ কেউ একটা কাপড়ের টুকরো নিয়ে গরুটার মুখের সামনে নাড়াত। নানা ভাবে গরুটাকে উত্যক্ত করা হত, যতক্ষণ না সে একটানে খুঁটিটা উপড়ে নিয়ে ছুট লাগায়।

ভয়ও পেতাম, আবার ব্যাপারটার মজাও উপভোগ করতাম। খেলাটার মধ্যে একটা আপোষে লড়ার ব্যাপার ছিল যেটা এমনকি, ছোটদেরও চোখ এড়াত না। মানে, বিরক্ত করা এ জন্যই যে প্রাণীটা শেষ অবধি ওই খুঁটি উপড়ে নিজেকে স্বাধীন করে নেবে। এই মজা একটু বড় হওয়ার পরে বোঝা যেত। যেটা বোঝা যায়নি, সেটা হল ভাইফোঁটার সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের সম্পর্ক। সেটা বুঝতে আরও অনেক বছর লেগেছিল।

২০০৯-এ রাজস্থানে যাওয়া বন্ধুসঙ্গে পড়ে। সেখানকার গ্রামে সেবার কথায় কথায় জানা গেল, সেই প্রশ্নের কিছুটা জবাব। তার সঙ্গে এটাও পরিষ্কার হল, বাংলার বাইরে কোথাও ব্যাপক অর্থে কালীপুজো নেই, তা হলে দীপাবলি এত বড় উৎসব কীসের। এ প্রশ্ন অবশ্য ইদানীংকার ধামাকা-উৎসবের আগের।

গুজরাত, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান অঞ্চলে দীপাবলির ঔজ্জ্বল্য ছিল প্রথাগত ভাবে সবচেয়ে বেশি। তার একটা অন্য রকম গল্প শোনা গিয়েছিল সেবার। প্রাকৃতিক কারণে এ সব জায়গায় কৃষির চেয়েও বেশি করে সাধারণ মানুষের জীবিকা ছিল পশুপালন। সে কাজটির জন্য দরকার হয় বিস্তৃত তৃণক্ষেত্রের। অপেক্ষাকৃত ঊষর অঞ্চলের, উত্তরাঞ্চলের পাহাড়েও পশুপালকদের তাই বিশাল পশুপালকে নিয়ে বছরের একটা বড় সময় থাকতে হয় নিজেদের গাঁ-ঘর ছেড়ে অনেকখানি দূরে। কখনও মধ্যপ্রদেশ থেকে বাংলা পর্যন্ত নরম মাটির, সহজ ঘাসের এলাকায় কখনও বা হিমালয়ের অপেক্ষাকৃত উঁচু চূড়ায় প্রসারিত তৃণভূমি (সকলে যাদের বলে বুগিয়াল) সেখানে মাসের পরে মাস কাটায় এই পশুপালকের দল। তাদের ঘরে ফেরা আসন্ন হয় বর্ষায়, শ্রাবণ মাসের শুরুতে। এই সমস্ত অঞ্চল জুড়ে শ্রাবণে তাই বড় আনন্দের, প্রত্যাশার উৎসব হল ‘তিজ’। প্রিয়জনেদের ঘরে আসার প্রত্যাশায় গাছে বাঁধা দোলনা, গাওয়া ঝুলা কি কাজরির গান।

কিন্তু শ্রাবণ তো সবচেয়ে শুকনো দেশেও বর্ষার ঋতু। যারা ঘরে ফেরে, তারাও নিজেদের ছোটর চেয়েও ছোট খেতগুলিতে লাগাত কোদো, মাড়ুয়া কি ভুট্টা। সে সব ফসলের চারায় ভেড়া-ছাগল-গরু মুখ দিলে চলে না। গ্রামে ফিরেও তাই পশুদের রাখতে হত বেঁধে। রোজকার এক প্রধান কাজ ছিল, পাহাড়ের মত টাল করে ঘাসপাতা, যাকে বলে ‘চারা’ তাই কেটে আনা।

সে কাজ কম পরিশ্রমেরও নয়, কম বিপদেরও নয়। বর্ষার মাসে ঘাসের মধ্যে ডাঁশ, পোকামাকড় ছাড়া সাপও থাকার আশঙ্কা প্রচুর। অথচ, উপায়ও নেই আর কিছু, চাষ বাঁচাতে হলে। তাকিয়ে থাকা কেবল কবে ফসল উঠে যাবে। করতে করতে শরত যায়। মাঠের ঘাসে যত ফুল তারা বীজ দিয়ে ঝরে পড়ে ভূঁইয়ে। সামনের বছর ঘাসের জন্ম সুনিশ্চিত করে। আর ক’দিনের মধ্যেই উঠে যাবে মাঠের ফসলও। এই হেমন্তে তাই খুঁটিবাঁধা থেকে মুক্তি দেওয়া যাবে গরু-ভেড়াদের। চারা বয়ে আনা থেকে ছুটি পাবে মেয়েরা আর বুড়োরাও। এত বড় একটা ঘটনাকে উদ্‌যাপন করা হবে না, তা-ও কি হয়?

পুরো সমাজ তাই এক দিকে আলো সাজায় দীপাবলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। হেমন্ত পূর্বজদের মাস, আকাশপ্রদীপের। সেই ছায়াপথ দিয়েই তো ভূতপ্রেতদেরও আনাগোনা। তাই ভূত চতুর্দশী, তাই আলো-উৎসব আর, পশুপালকদের মহা আনন্দ উৎসব পশুদের দড়ি থেকে খুলে মুক্তি দেওয়ায়।

বাংলার পশ্চিম অঞ্চলেও মাটি কিছু ভিন্ন গাঙ্গেয় সমভূমি থেকে। ছোটনাগপুর, ওডিশার সঙ্গে এর মিল বেশি—লাল আপাতরুক্ষ মাটিতে, উঁচুনিচু ভূমিরূপ আর অসংখ্য ছোট ছোট জলধারায়। মানুষদের জীবনযাপনও ছিল ভিন্ন এক মাধুর্যময়তায় ভরা। দূর পশ্চিমের উৎসবটি তাই পেয়েছিল এখানকার পশুপালকদের তৈরি এক পুরুলিয়া- সংস্করণ। কে বলতে পারে কোনটার বয়স বেশি, এখানে— দুর্গাপুজো না কাড়াখুঁটার?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন