রামধীরা আসলে একটা হারিয়ে যাওয়া নদীর নাম

ওলন্দাজ সাহেবরা বাংলার নদীর নাম ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারত না। তাই অদ্ভুত নামে নদীগুলোকে মানচিত্রে উল্লেখ করেছে। লিখছেন সুপ্রতিম সরকার বাংলার হারিয়ে যাওয়া নদীর ইতিহাস জানার পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন রায়। তাঁর দেখানো পথ ধরেই আমাদের হারিয়ে যাওয়া নদীগুলোকে খুঁজতে হবে। সাহেবরা বাণিজ্যিক স্বার্থে মূলত বাংলার নদীগুলোকে বোঝার চেষ্টা করেছিল।

Advertisement

সুপ্রতিম সরকার

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩১
Share:

সময়ের উপর সময়ের প্রলেপ পড়তে পড়তে মানুষের স্মৃতি থেকে নদীর নামটাই হারিয়ে গিয়েছে। নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গিয়েছে তারও আগে। নদীর নাম রামধীরা। এখনও পর্যন্ত মানচিত্র ছাড়া এই নদী নিয়ে লিখিত কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। বাংলার ছোট নদী চর্চার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় অন্তরায় তথ্যের অপ্রতুলতা। কিন্তু এই ছোট নদীগুলোই বাংলার ইতিহাসকে ভেঙেছে ও গড়েছে। বাংলার বুকে রাজা ও নবাবদের ইতিহাস খোদাই হলেও ছোট নদীগুলোর ইতিহাস এখনও পর্যন্ত লেখা হয়নি।

Advertisement

বাংলার হারিয়ে যাওয়া নদীর ইতিহাস জানার পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন রায়। তাঁর দেখানো পথ ধরেই আমাদের হারিয়ে যাওয়া নদীগুলোকে খুঁজতে হবে। সাহেবরা বাণিজ্যিক স্বার্থে মূলত বাংলার নদীগুলোকে বোঝার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা যে পুরোপুরি নদীগুলোকে বুঝেছিল, এমনটাও নয়। ডাচ সাহেবরাই বাংলায় প্রথম নদীগুলোর মানচিত্র তৈরি করে। সেই মানচিত্র মূলত ‘আই এস্টিমেশন’ বা চোখের আন্দাজে তৈরি ছিল। কাজেই সেগুলো নির্ভুল ছিল না। এ ছাড়াও আর একটা বড় সমস্যা রয়েছে। ওলন্দাজ সাহেবরা বাংলার নদীগুলোর বাংলা নামকে ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারত না। তাই তারা অদ্ভুত নামে নদীগুলোকে মানচিত্রে উল্লেখ করেছে। যেমন ১৬৬০ সালে প্রকাশিত ভেন-ড্রেন-ব্রুক সাহেবের মানচিত্রের কথা ধরা যাক। সেখানে ব্রুক সাহেব জলঙ্গি নদীকে ‘ডি গ্যালগাটিস স্প্রুইস’ নামে অভিহিত করছেন। ব্রুক সাহেবের মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য কতগুলি বড় নদী ছাড়া ছোট নদীর অস্তিত্ব নেই।

ব্রুক সাহেবের পরে বাংলা জুড়ে মানচিত্র রচনার কাজ করেছেন এফ ডি উইট (১৭২৫), টিরিয়ন (১৭৩০), ডেলিসলি (১৯৪০), এনভিল (১৭৫২), কিটচিন (১৭৬০), প্রমুখেরা। কিন্তু বাংলার নদীগুলোর ‘সিস্টেমেটিক সার্ভে’-র কাজটি করেন জেমস রেনেল সাহেব। কাজেই রেনেল সাহেবের তৈরি ম্যাপ প্রায় নির্ভুল। ১৭৬৪ সালের ৭ নভেম্বর ভাগীরথীর পথ ধরে ৩৯ জন সহায়ককে নিয়ে একটা বজরা ও ন’টি ডিঙি নৌকা নিয়ে তিনি বাংলার নদী জরিপে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গা বা পদ্মা থেকে এমন একটি নৌপথ বার করা যাতে সব ঋতুতেই বাণিজ্যের স্বার্থে নৌকা চলাচল করে।

Advertisement

১৭৮০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রেনেল সাহেবের ‘ম্যাপ অব কাশিমবাজার আইল্যান্ড’ শীর্ষক মানচিত্রটি যখন প্রকাশিত হল, সেখানে রামধীরা নদীর কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কাজেই অনুমান করা যায়, এই নদীর জন্ম ১৭৮০ সালের পরে। ১৮৫০ সালের এইচ এল থুইলারের মানচিত্রে প্রথম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে রামধীরাকে। প্রতাপপুরের কাছে ছোট ভৈরব নদী থেকে রামধীরার জন্ম। তার পরে ভবানীপুর, গোবিন্দপুর, আলিনগর, হুমাইনগর হয়ে চাঁদপুরের কাছে সুতী নদীতে মিশত। এই নদী প্রবাহিত হত হরিহরপাড়া ও আমতলা এলাকার মধ্যে দিয়ে।

কী ভাবে জন্ম নিল রামধীরা?

মূলত এই ধরনের ছোট ছোট শাখানদীকে নদী বিজ্ঞানের ভাষায় বলে স্পিল চ্যানেল। এমন নদীর জন্ম হয় বন্যাতে। ইংরেজ আমলের এক জন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন উইক্স। তিনি ‘নদিয়া রিভার্স ডিভিশনের’ বন্যা নিয়ে একটি টীকা লেখেন। সেই সময়ে ‘নদিয়া রিভার্স ডিভিশন’ এর মধ্যে অবিভক্ত নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ ছিল। উইক্স সাহেবের টীকা থেকে জানা যায়, ১৮২৩ সালে একটি বড় বন্যা হয়। সেই বন্যায় অনেকগুলো নদীর গতিপথও পরিবর্তন হয়। যেমন মাথাভাঙা নদীর উৎসমুখটি।

তবে ১৮২৩ সালের বন্যায় এই নদীর জন্ম কি না তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, ব্রুক ও রেনেল সাহেবের মানচিত্রে আমরা ভৈরবকে লক্ষ করতে পারি। ১৭৮০ সালের পরে প্রকাশিত মানচিত্রে আমরা দেখি ভৈরব নদীর মূল ধারাটি যথেষ্ট সঙ্কীর্ণ। ১৮০০ সাল থেকে ১৮৩১ সালের মধ্যে ভৈরব উৎসমুখে জল প্রায় পেত না বললেই চলে। কারণ পদ্মার মূল স্রোত পূর্ব পাড় বরাবর প্রবাহিত হতে শুরু করে। এ ছাড়াও ভৈরবের উৎস মুখে একটি বড় চর পড়ে যাওয়ায় পদ্মার জল ভৈরব নদীতে ঢুকতে পারত না। মার্চ মাস নাগাদ ভৈরব জলের অভাবে প্রায় শুকিয়ে যেত। বর্ষাতেই কেবল জল ঢুকত নদীতে। এমন জলের সঙ্কট নিয়ে একটা নদী থেকে নতুন নদীর জন্ম হতে পারে না।

১৮৩২ সাল থেকে আবার পদ্মা নদী তার পূর্বের গতিপথে ফিরতে শুরু করে। কাজেই পদ্মার সঙ্গে ফের ভৈরবের যোগাযোগ স্থাপন হয়। ১৮৩৮ সালে আর একটি বড় বন্যা আসে। সেই বন্যায় ভাগীরথীর জল বহরমপুরের কাছে ২৯ মিটার সাড়ে ৩ ইঞ্চি উঁচুতে উঠে যায়। পদ্মার খাতও জলে ভরে ওঠে। সেই বন্যাতে পদ্মার জল পেয়ে জলঙ্গি ও ভৈরব কানায় কানায় ভরে ওঠে। ভৈরবের ক্ষেত্রে দেখা যায় ১৮৩৮ সালের বন্যাতে নদীর মূল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে ছোট ভৈরবের পথ ধরে। বন্যার সময় বয়ে আনা জল ছোট ভৈরব যখন আর জলঙ্গি নদীতে ফেলতে পারল না, তখন সেই জলের চাপ প্রশমিত করতে রামধীরা নদীর জন্ম হয়।

রামধীরা ছোট ভৈরব থেকে জল বয়ে এনে সুতী নদীকে জল দিয়েছে। ১৯৬০ সালের আর্মি ম্যাপ সার্ভিস থেকে যখন টোপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ তৈরি হয়, তখন এই নদীটার ধারাকে সজীব দেখানো হয়েছে। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (১:৫০,০০০০ স্কেলের) প্রকাশিত টোপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপে রামধীরা নদীটাকে একটি কালো সুতোর মতো রেখা হিসাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু ধারাটার কোনও নাম উল্লেখ করা হয়নি। কালো সুতোর মতো নদীটাকে দেখানোর অর্থ হল শুধু বর্ষার সময় নদীতে জল থাকে।

ভাগীরথী ও জলঙ্গির মধ্যবর্তী এলাকা কালান্তর অঞ্চল নামে পরিচিত। হরিহরপাড়ার শেষ প্রান্ত থেকে দক্ষিণ দিকে পলাশি পর্যন্ত ভৈরব ও ভাগীরথীর মধ্যবর্তী নিচু অংশে বৃষ্টির জল দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কয়েক মাস। কাজেই রামধীরা নদীর পথ ধরে ছোট ভৈরবের অতিরিক্ত জল সুতীতে এসে মিশত। প্রকৃতির তৈরি এই উত্তম জল নির্গমণ ব্যবস্থা বন্যার প্রকোপকে বেশ কিছুটা কমাত।

হরিহরপাড়ায় নেমে এই নদীকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। স্থানীয় প্রবীণ বদরুদ্দিন মণ্ডল জানালেন, রামধীরা নদীর নাম তিনি শোনেননি। তবে সুতী নদীর নাম শুনেছেন। সুতী নদী হিসাবে যে মৃত নদীটাকে বদরুদ্দিন সাহেব দেখালেন, অতীতের মানচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সেটা আসলে রামধীরা নদী। স্থানীয় লোকজন রামধীরা নামটা জানেন না। তাঁরা জানেন, মৃত শাখাটা আসলে সুতী নদী। ওটা যে আসলে নদী, সেটাও বোঝার উপায় নেই। নদীর উপরে কয়েকটা জায়গায় দোকানপাট বসে গিয়েছে। নদী দখল করে চাষআবাদ হচ্ছে। বর্ষায় আশপাশের জল এসে জমা হয় নদীর খাতে। নদীর খাত বলতে তেমন কিছুই নেই। খুব সঙ্কীর্ণ একটা কাঁচা ড্রেন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। উৎস মুখেও নদীটা কোনও জল পায় না। কারণ ছোট ভৈরব গতিপথ পালটে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। প্রাকৃতিক কারণেই নদীটা মারা গিয়েছে। সম্পূর্ণ ভাবে নদীটাকে বাঁচিয়ে তোলা এখন প্রায় সম্ভব নয়। নদীর যেটুকু অস্তিত্ব রয়েছে, ১০০ দিনের কাজে তা সংস্কার করা সম্ভব। সেখানে বর্ষার জল ধরে রেখে মাছ চাষ যেমন হবে, তেমন সেচও হবে। নদীর সঙ্গে জুড়ে থাকে জীবন ও জীবিকা। তাই নিজেদের জন্যই নদীকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।

নদী বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন