বর্তমান শাসনে মানবাধিকারের উপর আক্রমণ বাড়ছে, বললেন সুজাত ভদ্র

গরিবের হয়ে বলাটাই দেশদ্রোহ!

কয়েক মাস আগে সুপ্রিম কোর্টে পুণে পুলিশের পিটিশনে কিন্তু একবোটে আর ভিডেই প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রধান অভিযুক্তদের ধরা হয়নি। সুতরাং পুলিশ বুঝেছে যে সেই একই কেসে এই সমাজকর্মীদেরও বেশি দিন আটকে রাখা যাবে না। তাই বেনামি চিঠি, যাতে নাকি প্রধানমন্ত্রীকে মারার ষড়যন্ত্রের কথা বলা আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রশ্ন: মানবাধিকার-কর্মীদের সাম্প্রতিক ধরপাকড় ও তল্লাশি অভিযানকে আপনি কী চোখে দেখছেন?

Advertisement

সুজাত ভদ্র: এই আক্রমণটা ‘শকিং’। যাঁরা এই জুন মাসেই বললেন, তাঁরা জরুরি অবস্থার শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে সব চেয়ে সরব হলেন, তাঁদের উপরই আক্রমণ হল। অনেক দিন ধরে মানবাধিকার সংগঠন বা সংগঠকরা শাসক দলের কাছে আতঙ্কের কারণ। এই আতঙ্কের কারণ, এক অর্থে আমরা নিরপেক্ষ নই। কেন নিরপেক্ষ নই? আমরা সত্য প্রকাশ করি, এবং নিখুঁত তথ্য যতটা সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছে দিই। ন্যায়বিচারের জন্য সত্য উন্মোচন কোনও শাসক দলের কাছেই খুব পছন্দের বিষয় নয়। তবে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল এ ক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক।

প্র: আপনি জুন মাসটাকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন।

Advertisement

উ: জুন মাসটা খুবই ঘটনাময়। ১৪ জুন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার প্রথম বারের জন্য কাশ্মীর সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন রিপোর্ট দিলেন। মানবাধিকার নিয়ে দীর্ঘ দিনের যে বিভিন্ন প্রতিবেদন, কিংবা রিপোর্ট, তার উপর দাঁড়িয়ে এই অবস্থান নির্মাণ হল। সুতরাং, মানবাধিকার কর্মীদের উপর সরকারের তীব্র আক্রোশ গিয়ে পড়ল। রাষ্ট্রপুঞ্জকে তো ধরা যাচ্ছে না ভীমা কোরেগাঁওতে, অতএব...।

প্র: এঁদের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে নাকি এঁরা জড়িত।

উ: আগে বলি, ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিতদের একটা আলাদা সত্তা আছে। সেখানকার হিংসায় এফআইআর হল মিলিন্দ একবোটে আর সম্ভাজি ভিডের নামে। কারা এঁরা? ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যাঁদের আশীর্বাদ চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী এবং দেবেন্দ্র ফডনবীস। কয়েক মাস আগে সুপ্রিম কোর্টে পুণে পুলিশের পিটিশনে কিন্তু একবোটে আর ভিডেই প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রধান অভিযুক্তদের ধরা হয়নি। সুতরাং পুলিশ বুঝেছে যে সেই একই কেসে এই সমাজকর্মীদেরও বেশি দিন আটকে রাখা যাবে না। তাই বেনামি চিঠি, যাতে নাকি প্রধানমন্ত্রীকে মারার ষড়যন্ত্রের কথা বলা আছে। এর ফলে দু’টি লাভ হল। প্রথমত দীর্ঘ দিন ধরে যাঁরা প্রান্তিক মানুষগুলোর হয়ে কথা বলছেন, তাঁদের কণ্ঠ চলে গেল, বলার কেউ রইল না। দ্বিতীয়ত, গোটা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হল: যাঁরা এ রকম কাজে জড়িত, তাঁরা মাওবাদী, এবং প্রধানমন্ত্রীকে মারার চক্রান্ত করছে বলে এঁরা দেশবিরোধী। ইন্দিরা গাঁধী আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে জরুরি অবস্থা জারি করে সবাইকে জেলে পুরেছিলেন। এরা অনুষ্ঠান না করেই জরুরি অবস্থা জারির প্রথম ধাপ চালু করে দিল। টেস্ট কেস হিসেবে সমাজকর্মীদের ধরা হল।

প্র: অর্থাৎ ভাবা হল, মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তুললে আর কেউ তাঁদের পাশে দাঁড়াবে না?

উ: হ্যাঁ, সেটাই। যে দশ জনকে ধরা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আট জনের সঙ্গে আমি আশির দশক থেকে ধারাবাহিক ভাবে কাজ করছি। তাঁদের কাজের ধারাটা বুঝতে হবে, তাঁরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারেন কি না বুঝতে হবে। তাঁদের লেখা-কাজকর্মের সুখ্যাতি আছে, দীর্ঘ দিন ধরে নিঃস্বার্থে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর রেকর্ড আছে। ভারাভারা রাও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বাইরে নতুন পথে সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন, তার প্রচার করেন। এঁদের কাজের প্যাটার্নের সঙ্গে ‘অ্যাসাসিনেশন প্লট’-এর ভাবনাটাই মেলে না। প্রশ্ন হল, এঁদের মতটা ভারতের উদারনৈতিক গণতন্ত্রে জায়গা পাবে কি না। যে দেশে নাথুরাম গডসের বই বিক্রি হতে পারে, ঘৃণার রাজনীতির বই বিভিন্ন স্টলে বিক্রি হতে পারে, গরুর নাম করে যারা লোক মারে তাদের গলায় মালা দেওয়া হতে পারে, সে দেশে কেবল গরিব মানুষের হয়ে কথা বলাটাই জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক? এটাই তো জরুরি অবস্থার সুর!

প্র: সরকার তো বলছে, এঁরা ‘আরবান নকশাল’।

উ: এই অভিযোগেরও একটা ধারাবাহিকতা আছে। সমস্ত মানবাধিকার সংগঠনকে নিষিদ্ধ সংগঠনের মুখপাত্র বলার ঐতিহ্য অনেক দিন ধরে চলছে। কারণ, আমরা অবদমিত, ক্ষমতাহীন, নিপীড়িত সংগঠন অথবা সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীর উপর দমন-পীড়নের নীতির বিরুদ্ধে বলি। ইতালীয় লেখক উমবার্তো একো বলেন, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুললে অত্যাচার চালাতে সরকারের খুব় সুবিধা হয়।

প্র: এমন কণ্ঠরোধের চেষ্টা হলে এ দেশে মানবাধিকার আন্দোলনের কী হবে?

উ: ভারতে অনেক রকম আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ধারণা গ্রহণ বা ধারণ করার মতো সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়নি। এ দেশে মৃত্যুদণ্ড বা গণপিটুনির পক্ষে যে ভাবে যুক্তি দেওয়া হয়, তাতেই বোঝা যায়, এ দেশের সমাজে সাধারণ ভাবে যে প্রবল ধারণাগুলো চলে, তার সঙ্গে মানবাধিকারের ধারণাটার গভীর বিরোধ। অর্থাৎ ‘লিবারাল ডেমোক্রাসি’ নেওয়ার মতো জায়গা ভারতের পরিকাঠামোয় তৈরি হয়নি। তা ছাড়া, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের মধ্যে তফাতটাও ঘুচিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ বলে, সরকার যা বলছে সেটাই ঠিক। দেশপ্রেমিক কিন্তু দেশের ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারে দেশকে ভালবাসে বলেই। বিখ্যাত ‘অ্যানার্কিস্ট’ এমা গোল্ডম্যান বলেছিলেন, যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় বড়লোকরা, সরকারেরা। সে যুদ্ধ সমর্থন করব কেন? একই ভাবে, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় আমি যদি মনে করি, দু’দেশের রাষ্ট্রনায়করা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, সে যুদ্ধ সমর্থন করব কেন? আমার দেশের আর পাকিস্তানের গরিব পরিবার থেকে যাওয়া সৈন্যরা মরবে কেন? কিন্তু এটা ভাবলেই এখন আমার গায়ে ‘দেশবিরোধী’ ছাপ মেরে দেওয়া হবে। মার্ক টোয়েনের কিছু লেখায় উগ্র জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমের মধ্যে ফারাক নিয়ে অসাধারণ ব্যাখ্যা আছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ কোনও ধরনের সমালোচনা সহ্য করে না, ‘ভেড়ার পাল’ মানুষ পছন্দ করে। প্রকৃত দেশপ্রেম কিন্তু অন্য দেশের দেশপ্রেমকেও সম্মান জানায়। তবে আমি আশাবাদী। একটা রুপালি রেখা দেখা যাচ্ছে। গণতন্ত্র হয়তো আবার সাধারণ মানুষের দ্বারা রক্ষিত হবে, সেই ১৯৭৭-এর মতোই।

সাক্ষাৎকার: তাপস সিংহ

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন