ছাত্রনেতা উমর খালিদ। —ফাইল চিত্র।
মনে হইয়াছিল, আমারও বুঝি ‘গৌরী লঙ্কেশ মুহূর্ত’টি উপস্থিত হইল। অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকবাজের হামলা হইতে রক্ষা পাইবার পরে ইহাই ছিল উমর খালিদের প্রতিক্রিয়া। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রনেতাকে দেশদ্রোহের অভিযোগে জেলে পুরিয়াছিল পুলিশ। ‘গৌরী লঙ্কেশ মুহূর্ত’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। গৌরী উমর খালিদের বিশেষ পরিচিত ছিলেন, ফলে তাঁহার কথা স্মরণে আসিতেই পারে। কিন্তু, মুহূর্তটি কি শুধু এক জন পরিচিতের মৃত্যুর ঘটনাক্রমের সহিত মিলের কথা মনে পড়াইয়া দিয়াছিল খালিদকে? না কি, ‘গৌরী লঙ্কেশ মুহূর্ত’ কথাটি শাসকদের বিরোধিতা করিবার মূল্য চুকাইবার দ্যোতক? না কি, খালিদ আরও এক ধাপ অগ্রসর হইয়া কথাটি বলিয়াছিলেন— গৌরীর মৃত্যু যেমন ছাপ্পান্ন ইঞ্চির রাষ্ট্রনায়কের মৌন ভঙ্গ করিতে পারে নাই, গোবিন্দ পানসারে বা এম এম কালবুর্গি বা শুজাত বুখারিদের মৃত্যু যেমন রাষ্ট্রের গায়ে দোলাটিও লাগাইতে পারে নাই, আততায়ীর গুলিতে তাঁহারও মৃত্যু হইলে রাষ্ট্রযন্ত্র তেমন নিষ্ক্রিয়ই থাকিত বলিয়াই খালিদের ধারণা? এবং, বিরুদ্ধবাদীর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের সমর্থনবাচক মৌনই প্রকৃত প্রস্তাবে ‘গৌরী লঙ্কেশ মুহূর্ত’? বস্তুত,শাসকদের প্রচ্ছায়ে এই হত্যাকাণ্ডগুলি, হত্যার প্রক্রিয়াটি, এবং বিরুদ্ধবাদীকে মারিয়া তাহার কণ্ঠরোধ করিবার মানসিকতাটি এমনই বৈধতা অর্জন করিয়াছে, এমনই গ্রহণযোগ্য হইয়া উঠিয়াছে যে ভারত একটি অবচ্ছিন্ন ‘গৌরী লঙ্কেশ মুহূর্তে’ বাঁচিয়া আছে বলিলেও ভুল হয় না। এই মৃত্যু উপত্যকাই এখন আমাদের দেশ।
হিংস্রতাকে বৈধতা প্রদান করাই নরেন্দ্র মোদীর জমানার প্রধানতম দিকচিহ্ন। রাজনৈতিক হিংস্রতা পূর্বেও ছিল। নাথুরাম গডসে সাক্ষী, এই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা কখনও যুক্তির পরিসরে বিরুদ্ধ মতের সহিত আলোচনায় আগ্রহী হয় নাই। তাহারা বিরোধীকে হারাইবার একটি পন্থাই জানে। কিন্তু, এই হত্যার নীতিকে বৈধ করিয়া তুলিল এই জমানা। স্পষ্ট ভাষায় বলিলে, নরেন্দ্র মোদী। তাঁহার স্বাভাবিক অমিতবাক সত্তা এই মুহূর্তগুলিতে উধাও হইয়া যায়। গৌরী অথবা শুজাত খুন হইলে, অথবা উমর খালিদের উপর আক্রমণ হইলে যে তীব্র নিন্দা এবং তিরস্কার তাঁহার নিকট প্রত্যাশিত, সে কথা দূরে থাকুক— তাঁহার মুখ ফুটিয়া একটি শব্দও বাহির হয় না। এই নীরবতাকে পাঠ করিতে সমাজেরও অসুবিধা হয় না, আগ্রাসকদেরও নহে। তাহারা বুঝিয়া লয়, ‘শত্রু’কে নিকাশ করিবার এই পন্থাটিই মান্য। রাষ্ট্রবাদী জনতাও জানিতে পারে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’দের জন্য এই শাস্তিই যথার্থ। এই পথই ভারতের পথ।
কিন্তু, যে জনতা ততখানি রাষ্ট্রবাদী নহে? যে রাজনৈতিক গোষ্ঠী অন্তত মৌখিক ভাবে উদারবাদে বিশ্বাসী, বাক্স্বাধীনতা-পন্থী? দায় কি তাহাদেরও নহে? কোনও প্রকৃত রাজনৈতিক আন্দোলন গড়িয়া তোলার কথা কি বিরোধীরা ভাবিয়াও দেখিয়াছেন? কর্নাটকে সরকার গ়ড়িবার তাগিদে কংগ্রেস মধ্যরাত্রে সুপ্রিম কোর্টে ছুটিয়া যাইতে পারে, কিন্তু তাহার তুল্য কোনও তৎপরতা কি এই মৃত্যুগুলির প্রতিবাদে তাহাদের ছিল? ভারত নামক একদা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী পরিসরটি ক্রমশ বেহাত হইয়া গিয়াছে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার কারবারিরা তাহার দখল লইয়াছে— উদারপন্থী বিরোধীরা তাহা দেখিয়াও দেখিতে পান নাই। বস্তুত, সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েকটি আন্দোলন হইয়াছে। কৃষকদের আন্দোলন, দলিতদের আন্দোলন। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি সেই আন্দোলনের পার্শ্বেও দাঁড়াইয়াছে। নাগরিক পরিসরে বাক্স্বাধীনতার, বিরুদ্ধ মত পোষণ করিবার স্বাধীনতার পার্শ্বে দাঁড়াইলে কোনও নিটোল ভোটব্যাঙ্কের সমর্থন মিলিবে না, সেই কারণেই কি কংগ্রেস আদি দলগুলির নিকট এই প্রশ্নটি গুরুত্বহীন হইয়া থাকিল?