Editorial News

কথাই তো আসল কথা

কথাতেই আস্থা রাখল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। আইনি যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, ওকালতির মারপ্যাঁচ, ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক, পুরাণ নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি— কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কে এই সবই হল আদালতে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯ ০০:৪১
Share:

এ দেশে বহুল পরিমাণে মান্য এক তত্ত্ব বলে, শব্দই ব্রহ্ম। ব্যক্তি চলে যায়, ব্যক্তিত্ব অন্তর্হিত হয়, কিন্তু উচ্চারিত শব্দগুলো বা কথাগুলো চিরন্তন হয়ে ভেসে বেড়ায় এ ব্রহ্মাণ্ডের কোনও না কোনও অংশে। তা হলে কথার চেয়ে বড় বা মহত্ প্রাপ্তি মানবজাতির পক্ষে আর কী হতে পারে?

Advertisement

কথাতেই আস্থা রাখল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। আইনি যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, ওকালতির মারপ্যাঁচ, ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক, পুরাণ নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি— কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কে এই সবই হল আদালতে। কোনও সিদ্ধান্তে বা নিষ্পত্তিতে পৌঁছনো গেল না তবু। নিষ্পত্তি আসলে এ সবে নেই। নিষ্পত্তি হতে পারে শুধুমাত্র কথায়, আলোচনায়, মধ্যস্থতায়। যথার্থ বুঝেছে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ। সেই মর্মেই নির্দেশ জারি হয়েছে।

সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ যে রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত সব পক্ষের পছন্দ হয়েছে, এমন নয়। ডিভিশন বেঞ্চের সামনেই আপত্তি তুলে ধরেছে বিভিন্ন পক্ষ। কিন্তু সে সব ধোপে টেকেনি। মধ্যস্থতাতেই সম্ভব এই বিবাদের নিষ্পত্তি— জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। গঠিত হয়েছে তিন মধ্যস্থতাকারীর প্যানেল।

Advertisement

যথাযথ পদক্ষেপ করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ইতিহাসে যদি ঘটে গিয়ে থাকে কোনও অনাকাঙ্খিত ঘটনা, তা হলে সে ঘটনার প্রায়শ্চিত্তের দায় দেশের সুপ্রিম কোর্ট নিতে পারবে, এমন তো নয়। বিচার বিভাগ তো ইতিহাসের অভিভাবক নয়। অনেকগুলো শতাব্দী আগে অন্যায় হয়েছিল, নাকি কয়েক দশক আগে অপরাধটা ঘটেছিল, সে বিচারে গিয়েও আর লাভ নেই। রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলাকে ঘিরে দেশে যে প্রলম্বিত তিক্ততার বাতাবরণ রয়েছে, তার স্থায়ী নিরসনই লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর সে নিরসন মধ্যস্থতায় বা আলোচনাতেই হওয়া সম্ভব, আদালতের কোনও কঠোর ঘোষণায় নয়।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন: মধ্যস্থতাতেই আস্থা, অযোধ্যা মামলায় তিন সদস্যের কমিটি তৈরি

আদালতকে রায় দিতে হলে শুধুমাত্র আইনি সংস্থান বা তার ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়েই দিতে হত। তাতে দু'পক্ষকেই সন্তুষ্ট করা যেত, এমন নিশ্চয়তা একেবারেই ছিল না। কিন্তু এই মামলা আর পাঁচটা মামলার চেয়ে অনেক আলাদা। আইন বা সংবিধান যতটা জড়িত এই মামলার সঙ্গে, তার চেয়ে অনেক বেশি করে জড়িত দুই সম্প্রদায়ের মানুষের আবেগ, অনুভূতি, বিশ্বাস। সাধারণ ছকের বাইরে থাকা এই সংকটের মোকাবিলা গতে বাঁধা কোনও পথে হওয়া কঠিন। তাই ছকভাঙা সিদ্ধান্ত নিল সুপ্রিম কোর্ট| এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো প্রত্যেক ভারতবাসীর কর্তব্য।

আবার বলি, কথাই আমাদের সম্বল। সভ্যতার গোটা ইতিহাসটাই কথায় নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। কথা ভালবাসা জাগিয়েছে, কথাই দ্বেষ ছড়িয়েছে, কথা প্রেমের জোয়ার বইয়ে দিয়েছে, কথাই যুদ্ধ লাগিয়েছে, কথা বিপ্লবের তুফান তুলে দিয়েছে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে, কথাই ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে| তাই মানুষে মানুষে কথা হওয়ার তাৎপর্য অসীম, মানুষে মানুষে কথা অভাবনীয় নানা সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সুপ্রিম কোর্ট তাই কথাতেই আস্থা রেখেছে, কোনও পক্ষের ভাবাবেগকে আহত না করে সর্বসম্মতিতে পৌঁছনোর পথ খুঁজে দিয়েছে। এই পথেই আস্থা রাখতে হবে ভারতকে আজ। কথায় সমাধান হবে, কথাই দৃঢ় করবে ভারতীয়ত্বের বন্ধন— এই আশায় বুক বাঁধা শুরু করতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement