প্যায়াসা-র শুটিংয়ের সময় প্রথম বার কলকাতায় আসি ১৯৫৬ সালে। এই গ্র্যান্ড হোটেলেই উঠেছিলাম। ‘অভিযান’, ‘খামোশি’র সময়েও তাই। ‘প্যায়াসা’-র ‘জানে ক্যা তুনে কহী’ গানটা শুট করা হয়েছিল গঙ্গার ধারে ওই যে বড় পিলারগুলো আছে, ওইখানে! রাত্তিরে শুটিং হত। আমি তো তখন নতুন! রাতের শুটিং ভাল সামলাতে পারতাম না। তার মধ্যেই করেছিলাম। গীতা দত্ত যা গেয়েছিলেন! ওঁর গলা ছিল সবার চেয়ে আলাদা। ওঁর গলায় আর আমার লিপে আর একটা গানও তোলা হয়েছিল গঙ্গায় নৌকোতে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, গানটা গল্পের গতি আটকে দিচ্ছে। সেটা আমি বলেছিলাম। গুরু দত্তজি পরে ওটা বাদ দেন। ‘প্যায়াসা’র সব গানই অবশ্য অসাধারণ হয়েছিল। সেই থেকে শুরু করে সোলবা সাল, কাগজ কে ফুল, কালা বাজার, গাইড, প্রেম পূজারি— এসডি বর্মনের অসংখ্য ভাল গানের সঙ্গে আমি জড়িয়ে গিয়েছি। শুধু বর্মনদাই নয়, মানিকদা, হেমন্তদা, অসিত সেন, বাসু ভট্টাচার্য— বাঙালিদের সঙ্গে আমার বরাবর একটা আলাদা ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে।
বর্মনদা যে হেতু গুরু দত্ত আর দেব আনন্দ, দু’জনের ছবিতেই মিউজ়িক করতেন, ওঁর সঙ্গে দেখা হত বাকিদের চেয়ে বেশি। মাঝে মাঝেই সেটে আসতেন। খুব পান খেতেন। গুরু দত্তজি আর ওঁর প্রোডাকশন ইনচার্জ গুরুস্বামীও পান ভালবাসতেন। ওঁরা খালি বলতেন, ‘‘দাদা এক পান দে দো না!’’ উনি বলতেন, ‘‘যাও যাও নিজেরা কিনে আনো!’’ কিন্তু আমি যেই বলতাম, ‘‘দাদা এক পান দোগে?’’ বলতেন, ‘‘হাঁ হাঁ ইধর আও!’’ আমাকে একদম ছোট বাচ্চার মতো দেখতেন! গুরু দত্তজি হইহই করে উঠতেন, ‘‘আমরা চাইলে তো দেন না! ওকে পান দিচ্ছেন, ও তো শট দেবে!’’ বর্মনদা জবাব দিতেন, ‘‘আরে পান খেলেও ব্ল্যাক-অ্যান্ড হোয়াইটে কিছু বোঝা যাবে না। ও তো তোমাদের মতো বেশরম নয়! তোমরা একটা পেলে দশটা চাইবে!’’
এক দিন ‘কালা বাজার’-এর সেট-এ এসে বললেন, ‘‘ওয়াহিদা একটা গান রেকর্ড করে এনেছি। এই রকম করে করবে দেখো...’’ বলে ধুতির কোঁচাটা ধরে নিজেই নেচে নেচে স্টেপিং করে গাইতে লাগলেন— রিমঝিমকে তরানে লেকে আয়ী বরসাত...। আমরা তো হেসে অস্থির! আর এক দিন আমি, নন্দা, শাকিলা সবাই মিলে রিগালে সিনেমা দেখতে গিয়েছি! উনিও সস্ত্রীক এসেছেন! আমাদের দেখেই বললেন, ‘‘আইসক্রিম খাবে?’’ আমরা তো অবাক! বর্মনদা চট করে হাত উপুড় করেন না, সবাই জানে! আজ হল কী? আমরা বললাম, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ খাব!’’ কিন্তু ওঁর স্ত্রী মীরাদি বললেন, ‘‘ওরা তো ডায়েট করে! আইসক্রিম খাবে কী?’’ যত বলি ডায়েট নিয়ে চিন্তা নেই, মীরাদি বলছেন, ‘‘না না তা কী করে হয়!’’ ব্যস সব ভেস্তে গেল!
আমার প্রথম ছবি তেলুগুতে, ‘রোজুলু মারায়ি’। একটা গানের সঙ্গে নেচেছিলাম। খুব জনপ্রিয় হয় গানটা। বর্মনদা এক দিন ফোন করে বললেন, ‘‘ওই গানটা শোনাও তো!’’ আমি তো গান গাইতে পারি না! উনি বললেন, ‘‘যেমন পারো তেমনই গাও। আমার সুরের গড়ন আর বিটটা দরকার!’’ শোনালাম। তিন-চার বার শুনলেন। ওই সুরটাই উনি বসালেন ‘বোম্বাই কা বাবু’ ছবিতে— দেখনে মে ভোলা হ্যায় দিল কা সলোনা..। তেলুগু ‘চিন্নান্না’ শব্দটাও ছিল। ‘চিন্নান্না’ মানে ছোট ভাই!
মানিকদার ছবি ‘অভিযান’-এ (ছবিতে একটি মুহূর্ত) কিন্তু সেই আমাকে নিজের গলাতেই গাইতে হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, ‘‘শিল্পীর গলা চাই না। তুমি তোমার মতো গাও।’’ শুধু গান কেন, আমার তো টেনশন ছিল, বাংলা বলব কী করে! মানিকদাকে বললাম, কী করে করব! উনি বললেন, ‘‘এটা ঠিক বাংলা নয়। বাংলা, হিন্দি, ভোজপুরী মেশানো সংলাপ। তোমাকে টেপ করে দেব। তুমি প্র্যাকটিস করতে পারবে।’’ সৌমিত্রও খুব হেল্প করেছিল। আউ়টডোরে একটা বড় হাভেলি ধরনের বাড়িতে সবাই এক সঙ্গে থাকা হত। লোকেশনটা খুব এনজয় করতাম। শুটিং শেষ করার পরে মানিকদা আমাকে বলেন, ‘‘ফিরে গিয়ে ‘গাইড’ উপন্যাসটা পোড়ো। ছবি করার কথা ভাবছি, তোমাকে রোজি-র চরিত্রটা করতে হবে।’’ সে ছবি হয়নি। পরে দেব আনন্দ ‘গাইড’-এর স্বত্ব কিনলেন। আমিই রোজি করলাম!
এর মধ্যে ‘সাহিব বিবি অউর গুলাম’ করতে গিয়ে হেমন্তদার সঙ্গে পরিচয় বেড়েছে। তার পর ওঁর প্রযোজনাতেও বেশ কয়েকটা ছবিতে আমি কাজ করি। হেমন্তদা যখন ছবি করতে এলেন, বীরেন নাগ প্রথম বার পরিচালনা করবেন। বীরেনকে ‘সিআইডি’-র সময় থেকেই জানতাম, উনি ছিলেন গুরু দত্তজির ইউনিটে শিল্পনির্দেশক। সাহিব বিবি-র কাজ শেষ হওয়ার পরে ‘বিশ সাল বাদ’-এর শুটিং শুরু হল। খুব হিট করেছিল ছবিটা। এর পর হল ‘কোহরা’। ওটা চলেনি তেমন। ‘রেবেকা’ থেকে নেওয়া। কিন্তু স্ক্রিপ্টটা খুব ভাল ছিল না। সাসপেন্স আর ড্রামাটা খুব দানা বাঁধেনি। আর একটা ছবিরও কথা হয়েছিল, ‘জেন আয়ার’ অবলম্বনে। কিন্তু সেটা হয়নি। এর পর হেমন্তদার প্রযোজনায় আমি অসিত সেনের সঙ্গে ‘খামোশি’ করি। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ আমি দেখেছিলাম অনেক আগে। চেন্নাইতে। তখনই মনে হয়েছিল, ছবিটা হিন্দিতে হলে করব। শিবাজি গণেশন করতে চেয়েছিলেন। হয়নি। পরে হেমন্তদা এক দিন বললেন, ‘‘আমি একটা ছবি করব। আপনি করবেন?’’ উনি আসলে ভাবছিলেন, বিষয়টা এমন, খুব একটা যদি না চলে! আমি যদি রাজি না হই! এ দিকে আমি তো অপেক্ষা করেইছিলাম! শুনে লাফিয়ে উঠলাম। অসিত সেন খুব সেনসিটিভ পরিচালক। উনিই প্রথম আমাকে বলেন, ‘‘পে অ্যাটেনশন টু ইয়োর ভয়েস!’’ তখন তো অভিনয়ের স্কুল ছিল না। পরিচালকদের থেকেই শিখতাম।
আমি তো তপন সিংহের সঙ্গেও কাজ করেছি ‘জিন্দেগি জিন্দেগি’-তে। ছবিটা ভালই হয়েছিল। তবে জায়গায় জায়গায় একটু বেশি চাপা হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়তো দর্শক ততটা নেননি। তবে আমার মনে হয়, বাঙালি পরিচালকরা আমাকে একটু বেশিই পছন্দ করতেন। ওঁরা মনে করতেন, আমাকে বেশ বাঙালি বাঙালি দেখতে। আর আমার অভিনয়ের ধরনটা ছিল নিচু তারে বাঁধা। সেটাও ওঁদের পছন্দ হত। মণি ভট্টাচার্য (মুঝে জিনে দো), শঙ্কর মুখোপাধ্যায় (বাত এক রাত কি), বাসু ভট্টাচার্য (তিসরি কসম), সবার সঙ্গে কাজ করেছি। গীতিকার শৈলেন্দ্র ‘তিসরি কসম’ প্রযোজনা করেন। বাসু তখন নতুন পরিচালক। ক্যামেরায় সুব্রত মিত্র। খুব ভাল লেগেছিল কাজ করে। সকলে প্রথম দিকে ভেবেছিলেন, রাজ কপূরকে ধুতি পরা গ্রাম্য চরিত্রে কতটা মানাবে! কিন্তু রাজজি খুবই ভাল করলেন! আর একটা জিনিস লক্ষ করলাম। উনি যখন অন্যের ছবিতে অভিনয় করেন, তখন শুধু অভিনয়ই করেন। পরিচালনায় মাথা গলান না। বাসু যদি কখনও আটকেও যেত, রাজজি উপদেশ দিতে যেতেন না। উনি মনে করতেন, ওটা বাসুর ছবি। সে যেমন মনে করবে, তা-ই হবে, আমার কাজ অভিনেতা হিসেবে সহযোগিতা করা, আমি সেটাই করব।
দিলীপসাবকে আবার দেখেছি, চিত্রনাট্য- সংলাপ কী হবে, সবের মধ্যে জড়িয়ে যেতেন। সহ-অভিনেতাদের পরামর্শ দিতেন। ওঁর অভিনয় ছিল খুব অন্তর্ভেদী। আর দেব ছিল চার্ম-এর রাজা। চাও বা না-চাও ভালবাসতেই হবে, এ রকম একটা অ্যাপিল। রাজ নিজেকে চার্লি চ্যাপলিনের আদলে গড়েছিলেন। হাসি-কান্না, দুইয়েতেই মাত করতে পারতেন। নায়িকাদের মধ্যে কী সৌন্দর্যে, কী অভিনয়ে আমার মতে মীনাকুমারী সেরা। সাহিব বিবি-তে ওঁকে যেমন দেখাচ্ছিল, আর উনি যা অভিনয় করেছিলেন, সেটা ‘পাকিজ়া’রও উপরে। কী বলব, আমরা মেয়েরা পর্যন্ত হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হত, শটটা কেন আরও লম্বা হল না!
অভিনেতাদের মতো পরিচালকদেরও যার যার নিজের জোরের জায়গা থাকে। কাজ করতে করতে বোঝা যায়। গানের দৃশ্যে যেমন রাজ খোসলা অসাধারণ। গুরু দত্ত গানের দৃশ্য আর আবেগের দৃশ্য দুইই খুব ভাল করতেন। বিজয় আনন্দও অলরাউন্ডার। দুরন্ত এডিটও করতেন। গাইড তো আসলে উনিই এডিট করেছিলেন। গুলজ়ারের শক্তি হচ্ছে লেখা আর সেনসিটিভ মন। যশ চোপড়া মানেই রোম্যান্স। যখন দেব আর হেমাকে নিয়ে জোশিলা করলেন, চলেনি। আমি ওঁকে বলেছিলাম, ‘‘যশজি থ্রিলার ইজ় নট ইয়োর কাপ অব টি!’’
কোনও দিনই চড়া অভিনয়, চড়া মেক-আপ’এ স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। স্বাভাবিক জীবন, স্বাভাবিক চরিত্র হলে তবেই সামলাতে পারতাম। মানুষ তো দোষেগুণে মিলিয়েই। আমরা ফরিশ্তাও নই, ভ্যাম্পও নই। তবে, বড় অভিনেতা তাঁরাই, যাঁরা খুব অদ্ভুতুড়ে দৃশ্যকেও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন! দিলীপসাব পারতেন, অমিতাভ পারে, নাসির পারে। আমি পারি না। সেই শুরু থেকেই প্রশ্ন করে এসেছি, এটা কেন, ওটা কী করে হচ্ছে! গুরু দত্তই আমাকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছিলেন, সব সময় লজিক লজিক কোরো না! একটু বাড়িয়ে না দেখালে কেউ দেখবে না! এটা সিনেমা, জীবন নয়!
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন:
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়