বিদ্যাসাগরের অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় হয়ে থাকার ব্যাপারটা কেমন যেন ভাবার আগেই সেটলড হয়ে থাকত।
ভদ্রলোকের কপালটাই মন্দ! তা নইলে কি তিন-তিন বার মুণ্ডহীন হতে হয়! ঘোরতর নকশাল আমলে এক বার, পোস্ট-জরুরি অবস্থা কালে এক বার এবং ‘অচ্ছে দিন’-এর এই আপাতত শান্তিকল্যাণের আমলে এক বার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামক মানুষটি মুণ্ডহীন হলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে হয়তো লিখে ফেলতেন ‘মৃত্যুর পরেও যেন মুণ্ডহীন হতে পারি’ গোছের পদ্য। ব্যঞ্জনা তৈরি হত অমরত্বের কেমিস্ট্রি নিয়ে। সেই সম্ভাবনা যখন নেই, তখন ভদ্রলোকের কুলুজি নিয়ে জ্যোতিষীর কাছে গমন ছাড়া অন্য উপায় নেই বলেই মনে হয়। কেন, ঠিক কী কারণে তিন-তিন বার...? এর মধ্যে কি কোনও গভীরতর ব্যঞ্জনা রয়েছে?
ল্যাম্পপোস্ট আর মাইলফলক
বাঙালি মিথ-জীবী প্রাণী। কোনও বিষয়কে আবহমানের সঙ্গে ত্যাগ করতে হলে তার মিথ চাই। জামাইষষ্ঠীর ফলারের মতো ফলাও করে কিংবদন্তি বানাতে না পারলে তার স্বস্তি নেই। বিদ্যাসাগরও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি যতটা না ‘বর্ণপরিচয়’, ‘সীতার বনবাস’, ‘শকুন্তলা’, তার চাইতে অনেক বেশি ল্যাম্পপোস্টের নীচে পড়া আওড়ানো আর মাইল ফলক দেখে ইংরেজি নম্বর শেখা। এই দুই গল্পই ভদ্রলোককে ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ করে রেখেছে বলা যায়। আজকের মলভ্রমী বাপ-মা’রা এই উদাহরণ দু’টি তাঁদের খুদেদের কাছে রাখেন কি না জানা নেই। কিন্তু আজ থেকে বছর তিরিশ–চল্লিশ আগেও ছা-পোষা বাঙালির গেরস্থালিতে এই দুই উদাহরণ ছিল জলভাত। ১৯৫০ সালে তোলা পাহাড়ি সান্যাল অভিনীত ‘বিদ্যাসাগর’ ছবিটি তখনও সিনেমা হলে মাঝেসাঝে অবতীর্ণ হতো। অভিভাবনের একটা অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে তা দেখাতেও নিয়ে যেতেন সেকালের বাপ-মা’রা। সেই ছবির গোড়াতেই ছিল ওই মাইল ফলক থেকে ইংরেজি সংখ্যা শেখার ব্যাপারটা। ফলে বিদ্যাসাগরের অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় হয়ে থাকার ব্যাপারটা কেমন যেন ভাবার আগেই সেটলড হয়ে থাকত। ‘সহজ পাঠ’-এর আগে সেই সময়ে পড়তে হতো ‘বর্ণ পরিচয়’। সব মিলিয়ে, সভ্যতার রং ও ঢং যা ছিল, তা আজকের ছানাপোনারা বিশ্বাসই করতে পারবে না। সেই সভ্যতায় মাইল ফলক আর ল্যাম্পপোস্ট খাপ খেয়ে যেত। বিদ্যাসাগরের পরবর্তী জীবনের মহিমা হয়ে উঠত প্রশ্নাতীত। বাঙালির আর কিছু দরকার পড়ত না।
কিন্তু দোজ ডেজ আর গন। মাইল ফলক আর বাতিস্তম্ভ দিয়ে মানুষটির মহাপুরুষত্ব আর সিকিওর করা যায়নি। তেমনই যায়নি ভদ্রলোকের কাজকম্মের একটা সঠিক খতিয়ান নির্ণয় করা। তাঁর কম-বেশি সত্তর বছরের জীবনে অক্লান্ত ভাবে বয়ে যাওয়া কর্মকাণ্ডের মানে কি আমবাঙালি বুঝেছে? বোঝার চেষ্টাও কি করেছে? ‘বর্ণ পরিচয়’-এর বাইরে কি তিনি একবর্ণও পঠিত? ‘সীতার বনবাস’ থাক, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’-ও কি বাঙালি পড়েছে গত অর্ধ শতকে? আর্কেইক ভাষার জালে আটকে থাকা ‘মহাপুরুষ’ বিধবা বিবাহ প্রবর্তন বা বহুবিবাহ বিরোধিতা নিয়ে এ কালকে তেমন স্পর্শ করতে পেরেছেন কি পারেননি, তাই নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশও কি বাঙালি পেয়েছে। ইন্দ্রমিত্রের বইতে আর আটকে থেকেছেন। মিথ প্রলম্বিত হয়েছে ‘সেই সময়’-এর মতো উপন্যাস থেকে। ১৯৭০, ১৯৭৮— এই দু’বার তাঁর মূর্তি কর্তনে সেই মিথ আরও দীর্ঘ হয়েছে। ২০১৯ তাকে আরও একটু বাড়িয়ে দিল— এর বেশি আর কী-ই বা বলা যায়।
চিরজীবী হয়ে
জীবদ্দশাতেও কি বিদ্যাসাগর তেমন মান্যতা পেয়েছিলেন? শান্তিপুরের তাঁতিরা ধুতি-শাড়ির পাড়ে ‘বেঁচে থাক বিদ্যেসাগর চিরজীবী হয়ে’ লিখে যতই তাঁকে সাপোর্ট করুক না কেন, বিধবা বিবাহ যে একটা ফ্লপ প্রোজেক্ট, তা তিনি নিজেও টের পেয়েছিলেন। শেষ জীবনে ‘খরমাতার’-এ বাণপ্রস্থের পিছনে সেই ব্যর্থতাবোধ কতটা ক্রিয়াশীল ছিল, সেই সব নিয়ে বাঙালি মাথা ঘামায়নি। ইয়ে মানে, ঘামানোর সময় পায়নি। বাম আমলে কি বিদ্যাসাগর ‘বুর্জোয়া’ তকমা প্রাপ্ত হয়েছিলেন? অতিবামরা তাঁকে অতি অবশ্যই ‘বুর্জোয়া’ শিক্ষাব্যবস্থার জনক বলেই চিহ্নিত করেছিলেন। (কী জ্বালা! অল্টারনেটিভ শিক্ষাব্যবস্থাটা কী, তা কি সেই উনিশ শতকের বাংলায় জানা ছিল!) বামেরা বিগত হলে বিবিধ ডামাডোলে বিদ্যাসাগর-চর্চাটাই হয়নি। তাঁর নামে মেট্রো স্টেশন হবে কি হবে না, তাই নিয়েও কোনও কূট দেখা দেয়নি। শেষমেশ তিনি একটা বিধানসভা কেন্দ্র, কয়েকটা কলেজ আর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে বেশি কিছু আদায় করতেও পারেননি। ফলে কী আর এমন ভারী পারসোনালিটি! মূর্তি থাকা বা না থাকায় কী-ই বা এসে যায়!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এসে সার সত্যটুকু বুঝেছিল তারাই, যারা মূর্তি ভাঙার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই এক ভাঁড়কে বিদ্যাসাগর সাজিয়ে জনসমক্ষে হাজির করে। মূর্তি ভাঙা যতটা না গোক্ষুরি, তার চাইতে ঢের কেলো ওই সঙ। বিধবা বিবাহ নিয়ে কাজিয়ায় বিরোধীপক্ষ জেলে পাড়ার সঙ বের করেছিল উনিশ শতকে। একবিংশে আবার সঙ। এর চাইতে ভাঙা মূর্তিও যে ঢের ভাল!
মাইল ফলক আর বাতিস্তম্ভ দিয়ে মানুষটির মহাপুরুষত্ব আর সিকিওর করা যায়নি।
অবিশ্যি নাকের বদলে নরুনের একটা গপ্পো ইতিমধ্যেই বাজারে ড্রপ খাচ্ছে। সেটা পঞ্চধাতু দিয়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতির গপ্পো। এখন প্রশ্ন, এত বস্তু থাকতে ‘পঞ্চধাতু’ কেন? এ কি ‘নাস্তিক’ বিদ্যাসাগরকে আস্তিক হিন্দুত্বে ব্যাক করানোর একটা প্রায়শ্চিত্ত? ‘পঞ্চগব্য’-এর বদলে ‘পঞ্চধাতু’? নাকি, পঞ্চধাতুর মধ্যেই রয়েছে পাকাপোক্ত অমরত্বের টোটকা? মেট্রো স্টেশনের নামকরণের চাইতেও পাকা সেই ব্যবস্থা।
এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী
মিথ নির্মাণ আর অর্ধশতকের মধ্যে মূর্তি ভাঙার হ্যাট্রিক— এর মধ্যেই আটকে রইলেন বিদ্যাসাগর। বেদান্ত আর সাংখ্য ভ্রান্ত দর্শন কি না জানা হল না, হোমিওপ্যাথিকেই কেন প্রকৃষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি বলে ভেবেছেলেন বৃদ্ধ, জানা হল না। তেমনই জানা হল না, ধর্ম সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট অভিমত। শ্রীম বিরচিত কথামৃতের পাতা আলো করে রইল শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বর্ণনা। পস্টারিটি তা থেকে যে পেল, তা তাঁর ‘মৃদু হাস্য’। না সেই হাসি ঠাকুরের প্রতি সৌজন্য থেকে জাত ছিল বলে আজ আর মনে হচ্ছে না। ঠাকুর ও তাঁর পারিষদদের সাক্ষী রেখে কি বিদ্যাসাগর তাঁর ভগ্ন-মূর্তি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই ‘মৃদু হাস্য’ করেছিলেন? তাঁর সেই ‘মৃদু হাস্য’ কি ছিল পঞ্চধাতু মণ্ডিত অনাগত কালের দিকে তাকিয়ে?
বিভূতিভূষণ তাঁর ম্যাগনাম ওপাসের মূল সুরটি বেঁধেছিলেন বিদ্যাসাগরের প্রকৃতি বর্ণনাকে ব্যবহার করেই। জনস্থান-মধ্যবর্তী প্রস্রবণ-গিরি। ‘পথের পাঁচালী’-র পথকেই বেঁধে দিয়েছিল গ্রামীণ পাঠাশালায় নেওয়া শ্রুতিলিখন। বিভূতিবাবু লিখছেন—
“ঐ পথের ওধারে অনেক দূরে কোথায় সেই জনস্থান-মধ্যবর্তী প্রস্রবণ-পর্ব্বত! বনঝোপের স্নিগ্ধ গন্ধে, না-জানার চাহায়া নামিয়া আসা ঝিকিমিকি সন্ধ্যায়, সেই স্বপ্নলোকের ছবি তাহাকে অবাক করিয়া দিল। কতদূরে সে প্রস্রবণ-গিরির উন্নত শিখর, আকাশপথে সতত-সঞ্চরমাণ মেঘমালায় যাহার প্রশান্ত, নীল সৌন্দর্য সর্বদা আবৃত থাকে?
সে বড় হইলে যাইয়া দেখিবে।”
নাঃ। বড় হইয়া আর দেখা হয় নাই। ইন ফ্যাক্ট, বাঙালি ‘বড়’-ই হয় নাই। মিথ আর ভাঙনের মাঝখানে আটকে গিয়েছে সে। বড় হয় নাই বলিয়াই পঞ্চগব্য, পঞ্চশস্যের ফাঁদে পা দিতে ভালবাসে। ভালবাসে বলেই ‘ভাঙা’ হয়। ভাঙার পরে সঙ বের করে তাকে জাস্টিফাই করাকেও ‘কেমন স্বাভাবিক’ বলে সহ্য করে। তাতে বিদ্যাসাগরের কিছু যায় বা আসে না। মূর্তি থাকা বা না থাকার তোয়াক্কা তিনি করতেন না বলেই মনে হয়। প্রায় লুপ্ত ‘বর্ণপরিচয়’-এর পাতায় গোপাল-রাখালের বাইনারি ঝামেলাকে লিখে তিনি বাঙালির চরিত্রের ধ্রুবপদকেই বেঁধে গিয়েছিলেন বলে মনে হয়। আপাতত মূর্তি-ভাঙিয়েরা রাখাল, প্রতিবাদীরা গোপাল। ক’দিন বাদেই জায়গা পাল্টা-পাল্টি হবে। কিন্তু, গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস অব্যাহত থাকবে, এ কথা মনে হয় সেই ক্রান্তদর্শী জানতেন। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে সাক্ষী রেখে তিনি ইঙ্গিতময় কিছু ‘মৃদু হাস্য’ রেখে গিয়েছেন আমাদের জন্য। সেটুকুই বাঙালি নামক এক এথনিক গোষ্ঠী তারিয়ে তারিয়ে চাখুক। এর বেশি আর কী-ই বা করতে পারে সে?
কার্টুন: দেবাশীষ দেব।