প্রবন্ধ ১

তোলার বদলে কর তুললেই তো ভাল

হকার সমস্যার সমাধান খুব সহজ নয়। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, এত দিন পরে কোনও সরকার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নির্লজ্জ দুর্নীতিকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণের আশা দেখিয়েছেন।হকার সমস্যার সমাধান খুব সহজ নয়। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, এত দিন পরে কোনও সরকার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নির্লজ্জ দুর্নীতিকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণের আশা দেখিয়েছেন।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৪৯
Share:

কিছু দিন আগে হকারদের নিয়ে একগুচ্ছ নতুন নীতির কথা ঘোষিত হয়েছে। যদিও নীতিগুলি সম্পর্কে বিশদ ভাবে জানা যাবে পরে, মোটামুটি ভাবে এই নীতিগুলির অন্তর্নিহিত দর্শন এবং এগুলো কার্যকর করার ব্যাপারে কিছু সমস্যার কথা উঠে আসছে। তাই হকার-অর্থনীতির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যা আমাদের ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

Advertisement

হকার বসতে দেওয়ার জন্য অলিখিত ভাবে, আইনের ঊর্ধ্বে তোলা দিতে হয়, এ কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দীর্ঘকাল ধরে সরকারি শাসনতন্ত্রের কোনও কোনও অংশ এবং রাজনৈতিক দাদা-ভাইয়েরা এই কার্যে লিপ্ত। ফলে এক কথায় হকাররা অনেক দিন থেকেই ‘কর’ দিচ্ছেন, শুধু সরকারের ঘরে তা জমা পড়ে না। জনগণের সম্পত্তির ওপর অর্থাৎ রাস্তা-ঘাট-ফুটপাথে যাঁরা ব্যবসা করবেন, তাঁদের সরকারকে কর দিতে হবে। সেটা লাইসেন্স ফি বাবদ বা অন্যান্য ভাবে নেওয়া যেতে পারে শুধু শুধু বেসরকারি পকেট ভরার জন্য তোলাবাজির পৃষ্ঠপোষকতা করা অন্যায়। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে সংস্কারের প্রয়োজন। এ কথা সত্যি যে, হকারদের আইনানুগ করা মানে এক বিশাল দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের জমিতে থাবা বসানো, অনেকের উপরি বন্ধ হওয়া, হকারদের অধিকার এবং উচ্ছেদের ভয় খানিকটা কমানো। প্রশ্ন হল, হকার নথিভুক্ত হওয়ার সময় যে-কেউ যেখানে-সেখানে নথিভুক্ত যেন না হয়।

এ বার আসি কতকগুলো জরুরি কথায়। কলকাতাকে হকারমুক্ত করা না গেলেও, যাঁরা কর দিয়ে, নানা ভাবে আইন মাফিক রাজ্য সরকারের রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন, তাঁদের স্বার্থ দেখতেই হবে। আর, হকারকে আইনানুগ স্বীকৃতি দেওয়ার মানে যদি যত্রতত্র আরও বেশি হকার গজিয়ে ওঠে, তা হলে সেটা হবে সম্পূর্ণ ভাবে উন্নয়ন-বিরোধী। এ কথাও মানতে হবে যে, এই রাজ্যে দীর্ঘদিন শিল্পায়ন বা স্বল্পশিক্ষিত বেকার সমস্যার সমাধান হয়নি বলে এত হকারের সৃষ্টি। সুতরাং, হকার সমস্যার দীর্ঘকালীন সমাধান তাঁদের পুনর্বাসনের মধ্যে নয়, রাজ্যের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নও বিশেষ প্রয়োজন।

Advertisement

সরকারের সামনে সমস্যা হল, কাকে নথিভুক্ত করবে আর কাকে করবে না, কোথায় কোথায় বসতে দেবে আর কোথায় কোথায় বসতে দেবে না। এখানে একটা বিশেষ সমস্যার কথা বলা দরকার। বর্তমানে অনেক জায়গায় এক জন মাত্র হকার বসেন না। সেই জায়গার ইজারা যদি ‘ক’ ব্যক্তি নিয়ে থাকেন, তা হলে দিনের বিভিন্ন সময় ‘খ’ ‘গ’ এঁরাও বসার সুযোগ পান ‘ক’-এর কাছ থেকে। এমতাবস্থায় একটি বিশেষ জায়গায় হকার চিহ্নিতকরণ দুষ্কর। তা ছাড়া কে কোথায় বসবে, সেটা ঠিক ভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। আপাতত আইনবহির্ভূত অসংগঠিত ভাবে সেটা ঠিক হয় বিভিন্ন দাদাদের দিয়ে। সরকারকে একটি কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে হবে।

তবে অর্থনীতির কথা হল, আমরা যখন কোনও কিছুকে আইন দিয়ে বন্ধ করতে চাই বা বেআইনি বলে ঘোষণা করি, তখন আসলে আমরা বিশেষ কিছু গোষ্ঠীকে দুর্নীতি করার সুযোগ এবং অধিকার দিই। হকার ব্যবস্থাও তার ব্যতিক্রম নয়। অসংগঠিত বেআইনি ব্যবসাকে মদত দেওয়ার পরিকল্পনার ভিত্তি হল, যাতে বিপুল বেকার সমস্যা এবং দারিদ্রের ফলে নৈরাজ্য ও বিপ্লব সৃষ্টি না হয়। তাই গরিব দেশে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার শেষ নেই। একটা জিনিস দশ টাকায় তৈরি করে কুড়ি টাকায় বিক্রি করলে, ওই দশ টাকার যে মার্জিন বা মুনাফা, সেটা বড়লোক দেশে যদি দু’জন মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী ভাগ করে নেন, তবে গরিব, কাজ পায় না, অশিক্ষিত, এমন দেশে দশ জন তা ভাগ করেন, আর তা থেকেই সৃষ্টি হয় তোলাবাজি, বেআইনি, দুর্নীতি। এটা বহুলাংশে এ রাজ্যে বিগত বাম জমানায় ব্যর্থ অর্থনীতির কুফল। আর ইতিহাস তো সহজে মরতে চায় না! যে মডেল আপাতদৃষ্টিতে সফল, সবাই সেটার অনুসরণ করেন।

ফলে হকার সমস্যার সমাধান খুব সহজ নয়। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, এত দিন পরে কোনও সরকার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নির্লজ্জ দুর্নীতিকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণের আশা দেখিয়েছেন। অর্থনীতিতে এ ধরনের সমস্যার একমাত্র প্রয়োজনীয় বিকল্প হল, ‘তোলা’কে সরকারি রাজস্বে পরিণত করা এবং এমন ভাবে করা, যাতে রাজনৈতিক ভাবে নীতিটি কার্যকর করা যায়।

দুটো বড় রাজনৈতিক সমস্যা হল যে, হকারেরা খানিকটা অধিকার পেলে পাড়ায় পাড়ায় প্রভাবশালী রাজনীতির মানুষরা দুর্বল হয়ে পড়বেন, তখন কী হবে? অন্য দিকে, রাজনীতির একটা দুরূহ সমস্যা হল, দানছত্রের সমস্যা। সরকারি রাজস্ব জনগণের টাকা। রাস্তাঘাট, ফুটপাথ জনগণের সম্পত্তি। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, যাঁরা আইন মাফিক কর দিচ্ছেন, তাঁদের অধিকার খর্ব না-করা, রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করা এবং আসলে সরকার যে জনগণের চৌকিদার, সেটা মনে রাখা। হকার নীতি একটি অর্থনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ।

এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ ঠিক ভাবে অনুসরণ করতে গেলে বিশ্বের অনেক দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তাইল্যান্ড, ঘানা, মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশে কোনও না কোনও ভাবে হকার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এবং তৎসম্পর্কিত আর্থসামাজিক সমস্যা নিয়ে বিশদ গবেষণা হয়েছে। হকার ব্যবস্থা এক অর্থে সব দেশেই ‘বেআইনি’, কিন্তু পুরোপুরি ইনফর্মাল বা অসংগঠিত নয়। সরকার দুর্বৃত্তদের হাত থেকে নিজেদের হাতে রাজস্ব নিয়ে আসার চেষ্টা করে সফল হয়েছে, কোথাও কোথাও হকারদের সমস্যা বেড়েছে বা কমেছে। কিন্তু করদাতাদের কথা মনে রেখেই সব করা হয়েছে বা চেষ্টা করা হয়েছে। দোকানের সাইনবোর্ড ঢেকে দিয়ে ব্যবসা করার অনুমতি দিলে সেটা এক ধরনের নৈরাজ্য। অন্য দিকে, গড়ের মাঠের ধারে সেফটিপিন বিক্রি করার যা মুনাফা, গড়িয়াহাটের মোড়ে সেটা বিক্রি করার মুনাফা অনেক বেশি। তাই সরকারকেও লাইসেন্স দিলে তার ফি ভেবেচিন্তে নির্ধারণ করতে হবে। কোথাও আমি জাঁকিয়ে বসে আছি, তাই সেখানে আমার অধিকার বলবৎ হবে, তেমনটা যেন না হয়।

পরিশেষে একটা কথা। ভারতবর্ষের রাজনীতি আসলে দল-মত নির্বিশেষে এক অর্থে ‘পাইয়ে দেওয়া’র রাজনীতি, আর সে রাজনীতির জোরে যদি ভোট এবং ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়, সবাই সেটা করবেন। তা নিয়ে অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেন, তাঁরা আসলে সত্যটা স্বীকার করতে চান না। কিন্তু এ ধরনের নীতির আড়ালে আবডালে কিছু ভাল কাজ হয়ে যায়। নেতাদের মুনসিয়ানা হয়তো এখানেই। হকার সমস্যার অর্থনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের একটাই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং শর্ত। সেটা মেনে চললে কিছুটা কাজ হবে, নচেৎ নয়। কোনও ভাবে তোলাকে খানিকটা হলেও লাইসেন্স ফি-তে রূপান্তর করতে হবে, হকারদের নথিভুক্ত করে প্রতি মুহূর্তে উচ্ছেদের ভয় খানিকটা নিবারণ করতে হবে। নির্লজ্জ দুর্নীতির কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হবে তা হলে। রাস্তাঘাট, ফুটপাথে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে ব্যবসায়ী, কিন্তু তাঁরা জনগণের ‘সম্পত্তি’র ওপর ব্যবসা করেন, জনগণকে অর্থাৎ জনগণের চৌকিদার সরকারকে তাঁদের উপযুক্ত দাম দিতে হবে, যা এখন তাঁরা দুর্বৃত্তদের দেন। সরকারকে লাইসেন্স ফি বাবদ কর দিয়ে নিজেদের সম্মান রক্ষা করবেন। পাইয়ে দেওয়ার নামে সংস্কার হতেই পারে, কিন্তু উল্টোটা যেন না হয়।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন