সাতাশি সালের কথা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর সঙ্গে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কলকাতা থেকে সেখানে এসে পৌঁছেছিলেন। মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠানে দু’জনেই যোগ দিলেন। সেখানেই মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা ছিল। রাজীব গাঁধী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বুফে থেকে খাবার তুলে তুলে খাচ্ছিলেন। প্রবীণ জ্যোতিবাবু রাজীবকে বললেন, ‘‘আমি বাপু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাত খেতে পারি না।’’ টেবিলে থালা রেখে মাছ-ভাত খেলেন তিনি। রাজীব গাঁধীর বয়স তখন কম। প্রায় দৌড়চ্ছেন তিনি। টগবগ করে যেন ফুটছেন। এ হেন রাজীব গাঁধী জিএনএলএফ নেতা সুবাস ঘিসিংকে সঙ্গে নিয়ে দার্জিলিংয়ে একটা চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন জ্যোতিবাবু ও সিপিএমের উপর। বুটা সিংহকে সামনে রেখে দার্জিলিং চুক্তি নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য এক অসম্ভব টানাপড়েন জ্যোতিবাবুকে সামলাতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত জ্যোতিবাবু কিন্তু পরিস্থিতিটা সামলে নিয়েছিলেন। তিনি ঘিসিংয়ের সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছিলেন। ঘিসিংকে অনেক টাকাপয়সা দিতেন। গোর্খা পার্বত্য পরিষদ দুর্নীতির চোরাবালিতে ডুবে গিয়েছিল। জিএনএলএফ ভোট বয়কট করত। সিপিএমের প্রার্থী ড্যাং ড্যাং করে জিতত দার্জিলিং থেকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্প্রতি দার্জিলিং ঘুরে এলাম। এ বার গিয়েছিলাম কালিম্পং। কিছু দিন আগে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও দার্জিলিং গিয়েছিলাম। তখনও মমতা দার্জিলিং এসেছিলেন। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম দিকে মমতার সঙ্গে বোঝাপড়া করেই চলছিলেন গুরুঙ্গ। এখন কিন্তু প্রবল এক সংঘাতের আবহ।
দার্জিলিংয়ে পুর নির্বাচন আসন্ন। ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট হওয়ার কথা। এই ভোট নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করে না। রাজ্য সরকারই ঠিক করবে, ভোট কখন হবে। ডিসেম্বরে খুব শীত। তাই ডিসেম্বরের জায়গায় ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ভোট হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু এখন গুরুঙ্গের আন্দোলন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাঁর জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সন্ত্রাস করার ক্ষমতাও গুরুঙ্গ-বাহিনী হারিয়েছে। হরকাবাহাদুরের মতো নেতা গুরুঙ্গকে ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এ বার তো কালিম্পংয়ে, যেখানে গুরুঙ্গের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল, সেখান থেকে গুরুঙ্গ জাতিগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ খোলা আকাশের নীচে ঝকঝকে রোদ্দুরে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের উপস্থিতিতে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন।
পাহাড়ে এক দিকে যেমন জিটিএ রয়েছে, তেমনই লেপচা, তামাঙ্গ, ভুটিয়াদের পৃথক বোর্ড গঠন করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। সেগুলিকে রাজ্যের পক্ষ থেকে অর্থবরাদ্দ করা হচ্ছে। মুখ্যসচিবের উপস্থিতিতে এই সব সম্প্রদায়ের হাতে চেক তুলে দেওয়া হচ্ছে। মমতার যুক্তি হচ্ছে, এর ফলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে। অন্য দিকে জাতিসত্তাগুলি তাদের স্বাধিকার লাভ করছে। গুরুঙ্গের অভিযোগ, এর মধ্যে রাজনীতি রয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস তার সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য এই কাজ করছে। এমনকী, গুরুঙ্গ বাহিনী সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে অভিযোগ এনেছে যে জিটিএ-কে টাকা দেওয়া হচ্ছে না। গুরুঙ্গ নিজে কেন্দ্রের দ্বারস্থ হওয়ার চেষ্টা করছেন। বিজেপি সাংসদ সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সাহায্য নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে মমতাকে চাপের মুখে ফেলতে চাইছেন।
আসল লড়াই তাই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের। জ্যোতিবাবু পাহাড়ে সিপিএমের বৃদ্ধির চেষ্টা না করে দার্জিলিংকে সুবাস ঘিসিংয়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আনন্দ পাঠককে জেতাতে সুবাস ঘিসিং সাহায্য করতেন ভোট বয়কট করে। কিন্তু সেই আনন্দ পাঠকই এক বার দিল্লিতে আমার কাছে দুঃখ করেছিলেন যে পাহাড়ে কমিউনিস্ট পার্টির বিকাশের একটা ইতিহাস ছিল। কমিউনিস্ট আন্দোলনে গোর্খাদের ভূমিকা ছিল। কিন্তু সেই হৃতগৌরব আর ফিরে পাওয়া গেল না। দার্জিলিংয়ে গোর্খারাই শক্তিশালী জনগোষ্ঠী। কিন্তু লেপচারা দাবি করে, তারা এই এলাকার প্রাচীনতর বাসিন্দা। লেপচাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। দার্জিলিংবাসী গোর্খাদের ভাষা গোর্খালি। যার সঙ্গে নেপালির বেশ কিছুটা ফারাক রয়েছে। এই গোর্খা সম্প্রদায় নিজেদের পৃথক জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তারা নিজেদের নেপালি বলে না বা ভাবে না। এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দিনের অবদমিত লেপচা সত্তাকেও স্বাধিকারের সুযোগ দিয়েছেন মমতা। একটা মত হল, এই ভাবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে আলাদা আলাদা করে রাজনৈতিক পরিসর দিলে তাতে বহুত্ববাদ হবে না কি আরও বেশি বেশি করে খণ্ড জাতীয়তাবাদের পথে দার্জিলিং এগোবে? আজ না হলেও ভবিষ্যতে এর ফলে জাতিদাঙ্গা বাড়বে না তো? তার উপর রয়েছে চিনের মতো দেশের নানা ধরনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধন। কালিম্পংয়ের মিলিটারি বেস এই কারণে ভারত সরকারের কাছে আজও সংবেদনশীল। মমতার বক্তব্য, ভারত সরকার যেমন বিভিন্ন প্রান্তবাদের উপর রোলার চালিয়ে অখণ্ড জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিতে পারেন না, ঠিক তেমন ভাবে দার্জিলিংয়েও শতপুষ্প বিকশিত হোক।
এই অস্থিরতার পরিণতি যা-ই হোক না কেন, আপাতত পরিস্থিতিটা এই রকম যে, মমতা দুর্বার গতিতে এগোচ্ছেন আর গুরুঙ্গ নিজের বাসভূমিতেই কার্যত পরবাসী।
অনিবার্য কারণবশত এ সপ্তাহে শাহি সমাচার প্রকাশিত হল না।