কোনও বিল পেশ হইবে, না পাশ হইবে, না কি আপাতত কিছু কাল স্থগিত হইবে: সংসদের কক্ষে এই টানাপড়েন চলিতেই পারে, চলাটাই স্বাভাবিক। অথচ, দুর্ভাগ্য, ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যে অনেক সময়েই দেখা যায়, যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা ছাড়াই অতি গুরুতর বিষয়ে বিল পেশ ও আইন পাশ হইয়া যায়। সংসদের কাজ কিন্তু কেবল একটির পর একটি আইন প্রণয়ন করিয়া যাওয়া নহে, সংসদের প্রধান কাজ বহুপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে দেশের কোনও বিশেষ সামাজিক বা অর্থনৈতিক বা নৈতিক সমস্যার স্বরূপ অনুধাবন করিয়া ভবিষ্যৎ পথ বিষয়ে একটি মতৈক্যে আসিবার চেষ্টা করা। এই লক্ষ্যেই দেশের নানা প্রান্ত হইতে নানা দলচিহ্নিত জনপ্রতিনিধিরা একত্র আসিয়া বসেন। না হইলে তাঁহারা নিজ নিজ ভবন হইতে বোতাম টিপিয়াই ভোটাভুটি করিতে পারিতেন। কথাটি সহজ। নিজেদের মধ্যে মতৈক্যে আসা না গেলে ভোটাভুটি চলিতে পারে বিধিসম্মত ভাবেই। কিন্তু ভোটাভুটির নিদানটি হাতে আছে বলিয়া আলোচনা এবং মতৈক্য নির্মাণের প্রয়াসই করিব না: ইহা আসলে গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাতন্ত্র চালানো, অর্থাৎ সংখ্যার জোরে দেশ-শাসনের অসহিষ্ণু চেষ্টা। এ বারের শীতকালীন অধিবেশনে তিন তালাক বিল লইয়া যে কাণ্ড হইল, দেখিয়া শুনিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া গতি নাই। কোনও শুভবোধজাত সামাজিক সংস্কারের পথ ইহা হইতে পারে না। সংস্কার-ইচ্ছাটি পুরাদস্তুর রাজনীতি-কণ্টকিত হইলেই একমাত্র বিল পেশের নামে এই অশালীন দরাদরি ও অশান্তি সম্ভব। সংসদবিষয়ক মন্ত্রী যখন বলেন, বিরোধী নেতারা বিলটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাইতে চাহেন কেননা তাঁহারা ‘মুসলিম মা-বোনেদের কথা ভাবিতে নারাজ’, তখনই বোঝা যায় সংসদের অন্দরে সংসদীয় প্রক্রিয়ার টুঁটি চাপিয়া ভোটের রাজনীতিটিই উদ্ধত হইয়া উঠিতেছে।
তিন তালাক বিল লইয়া সুপ্রিম কোর্ট আইন তৈরি করিতে বলিয়াছে ঠিকই, কিন্তু কোনও ধরাবাঁধা সময় দেয় নাই। সুতরাং এতখানি তাড়া অপ্রয়োজনীয়। বিশেষত যখন আদালতের রায়ের অপেক্ষা প্রস্তাবিত বিলের খসড়াটিতে দুই-একটি জায়গায় অমিল আছে, তাহার জন্য কিছু সময় অবশ্যই লাগিতে পারে। আলোচনার মাধ্যমেই এই অমিলগুলিকে স্পষ্ট করিতে হইবে, এবং সরকার পক্ষকে বলিতে হইবে, পরিবর্তনগুলি কেন। যেমন, স্বামী তিন তালাক উচ্চারণ করিলে তাহা অর্থহীন, তাহাতে স্ত্রীর অবস্থানের তারতম্য ঘটিবে না, এই কথা বলা এক। আর তালাক উচ্চারণ করিলেই স্বামীকে ফৌজদারি ধারায় শাস্তিপ্রাপ্ত হইতে হইবে, এই কথাটি আর এক। বাস্তবিক, যদি উচ্চারণটি অর্থহীন হয়, এবং স্ত্রীর উপর বলপ্রয়োগের ঘটনা না ঘটে, সে ক্ষেত্রে কেন স্বামী গ্রেপ্তার হইবেন, তাহা স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে জনপ্রতিনিধিরা আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত মত তৈরি করিবেন, ইহাই প্রত্যাশিত।
সহজ ভাষায়, তিন তালাক প্রথা রদ করা মুসলিম সমাজের জন্য জরুরি হইলেও, বিজেপি যে তিন তালাক লইয়া রাজনীতি করিতে কোমর বাঁধিয়া নামিয়াছে, সন্দেহ নাই। মুসলিম সমাজের আরও অনেক উন্নয়নযোগ্য ক্ষেত্র আছে, সে দিকে সরকারের তেমন দৃষ্টিপাত দেখা যায় না। বিরোধী নেতা রাহুল গাঁধী ইহাও যথার্থ বলিয়াছেন যে, তিন তালাক বিল লইয়া সরকারের যে অতি আগ্রহ, লোকপাল বিলের মতো অন্যান্য ক্ষেত্রে তাহা দেখা গেলে উত্তম হইত। সামাজিক ন্যায়ের নামে দলের ভোট-গোছানো, গণতন্ত্রে অচেনা পদ্ধতি নহে। কিন্তু এতখানি স্পর্ধা ও অসহিষ্ণুতার সহিত সে কাজ হইলে তাহা গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার বাহিরে চলিয়া যায়। ‘মুসলিম বোনেদের’ নামে হিন্দু ভোট কুড়াইবার আদেখলেপনা বিজেপি বন্ধ করুক। সামাজিক ন্যায় একটি গুরুতর বস্তু। তাহাতে এত তাড়াহুড়া চলে না।