টানাপড়েন: আন্তঃরাজ্য পরিষদের সম্মেলন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। দিল্লি, জুলাই ২০১৬
ভু বনেশ্বর এক আশ্চর্য শহর। দিল্লিতে আপনি চান বা না চান সারাক্ষণ চারিদিকে পোস্টারে ব্যানারে নরেন্দ্র মোদীকেই দেখতে হয়। কলকাতায় সর্বত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ বার বেশ কিছু দিন পর এ শহরে এসে কোথাও নবীন পট্টনায়কের একটাও ছবি, পোস্টার, ব্যানার দেখলাম না। বিমানবন্দরের কাছে আছে বিজু পট্টনায়কের একটা সুদীর্ঘ মূর্তি। কিন্তু নবীনবাবু? কোথাও নেই।
চমৎকার রাস্তা। পুরনো ভুবনেশ্বর আরও নিরিবিলি। পুরী আসতে দেড় ঘণ্টা। নবীনবাবু না থাকলেও প্রচুর পোস্টার দেখলাম নরেন্দ্র মোদী আর তার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের। রাজ্যে বিজেপির ভাবী মুখ্যমন্ত্রী-পদপ্রার্থী?
পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরের সামনে গায়ে গামছা, হলদে তসরের ধুতি, মোটা পৈতেধারী প্রবীণ পূজারি এ ব্যাপারে কী বলছেন? শুনুন! ‘নবীনবাবুর কোনও পোস্টারের দরকার নেই। উনি আছেন আমাদের হৃদয়ে। বিজুবাবুর ছেলে যত দিন সুস্থ তত দিন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। তবে শুনেছি উনি অসুস্থ। আমেরিকা চলে যাবেন চিকিৎসার জন্য। ওঁর জায়গায় অন্য কাউকে আমরা মানতে পারব না। তার চেয়ে বিজেপি আসাই ভাল।’ তবে জয় পন্ডার নবীন-বিরোধী কার্যকলাপেও ওড়িশার বহু মানুষ আবার রাগে অগ্নিশর্মা। জয় পন্ডার ‘বিশ্বাসভঙ্গ’কেও না-পসন্দ ওড়িশাবাসীর।
পুরীর জগন্নাথ মন্দির শুধু নয়, ঢেঁকির ধান ভাঙার কাজ চালাচ্ছিলাম সমুদ্রতীরেও। বাঁক কাঁধে মোহনভোগ বিক্রেতা গোবর্ধনই হোক আর রিকশাচালক শ্রীমান দুঃশাসন, সকলেই নবীনভক্ত। ওড়িশায় জাতপাতভিত্তিক গোষ্ঠী রাজনীতি কংগ্রেস জমানায় দেখেছি। জে বি পট্টনায়ক, নন্দিনী শতপথি, কে পি সিংদেও, বা জনজাতি নেতা গিরিধর গোমাঙ্গ। কিন্তু এ এমন এক রাজ্য যেখানে মুসলমান জনসমাজ কার্যত নেই। শ্রীচৈতন্য ভক্তি আন্দোলনের বৈষ্ণব প্রভাবে হিন্দু সমাজেও জাতপাতের বৈষম্য কম। এ রকম একটা রাজ্যে দারিদ্র আছে, কলাহাণ্ডি আছে, কলিঙ্গে পসকোর কারখানা করতে গিয়ে গুলি ছুটেছে, কর্মসংস্থান নেই, শিল্প নেই, আর এই রাজ্যে এ বার হিন্দুত্ব আর বিকাশের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নরেন্দ্র মোদী হাজির।
১৫ এপ্রিল ভুবনেশ্বরে দলের কর্মসমিতির বৈঠক তো এ কারণেই। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে জয়লাভের পর অমিত শাহ আমাকে বলেছিলেন, এ বার বিজেপিকে ‘প্যান-ইন্ডিয়ান’ দল করাই আমার সবচেয়ে বড় লক্ষ। আমরা শুধু গোবলয়ের পার্টি নই তার প্রমাণ দেব। এমনকী অমিত শাহ বাংলা আর তামিল ভাষা শিখতেও শুরু করেছিলেন।
তিন দশক আগে যখন প্রথম দিল্লি আসি তখন অশোকা রোডের বিজেপি অফিসে ঢোকার মুখে দুটো পাশাপাশি ঘরে বসতেন দুই সচিব কৃষাণলাল শর্মা আর জে পি মাথুর। তখনও ওঁরা বাঙালি সাংবাদিক পেয়ে বোঝাতেন, পূর্ব আর দক্ষিণ ভারত, এই দুই অঞ্চলেই আরএসএস-এর সংগঠন শক্তিশালী হলেও বিজেপি দুর্বল। আমাদের এটাই চ্যালেঞ্জ। রামমন্দির আন্দোলনের সময় আডবাণী গোবিন্দাচার্যকে পশ্চিমবাংলার জন্য অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে বলেছিলেন। তখন থেকেই রামমন্দিরের বদলে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আর বঙ্কিমচন্দ্র নেতাজি নিয়ে প্রচারের কৌশল ভাবা হয়।
মনে আছে, ১৯৮৫ সালে বড়বাজারে এক সংঘ সমর্থক ব্যবসায়ীর বাড়িতে প্রয়াত বিজেপি নেতা কেদারনাথ সাহনির সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম। তিনিও বলেছিলেন, কলকাতায় কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রশ্নেও প্রচার চালাব। বাঙালি কাশ্মীর ইস্যুও গ্রহণ করবে।
এখন মোদীর সিওও-র কৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মতাদর্শের চেয়েও বাস্তববাদ হল অগ্রাধিকার। অমিত শাহ গুজরাতি হলেও জন্ম মুম্বই শহরে। স্টকব্রোকার হিসাবে জীবন শুরু। মারিয়ো পুজো-র গডফাদারকে মনে আছে? গডফাদার এক সহকর্মীকে কাঁদতে দেখে বলেছিল, কী আশ্চর্য, তুমি মানুষের মতো ব্যবহার করছ কেন? তা হলে তুমি সফল হবে কী করে? অপারেশন ইজ অপারেশন।
অতএব প্যান-ইন্ডিয়া দল হওয়ার জন্য গোটা দেশটাই একটা ল্যাবরেটরি। যে সব রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ গুরুত্বপূর্ণ সেখানে মেরুকরণ সম্ভব হবেই। আবার রেনেসাঁস শহর কলকাতার বিদ্বৎসমাজের জন্য ফর্মুলা আলাদা। সব রোগীর জন্য চিকিৎসক একই পথ্য দেন না। অসমেও মেরুকরণ সম্ভব হয়েছে। এ সব রাজ্যে উগ্র ইসলামের বিরোধী প্রচারও জরুরি।
যে সব রাজ্যে সংখ্যালঘু নেই, যে রাজ্যে রামমন্দির নেই, যে রাজ্যে আর্য হিন্দুত্ব নেই, হিন্দি-জাতীয়তাবাদ নেই, সে সব রাজ্যে কৌশল হবে ভিন্ন। যেমন ওড়িশা অথবা তামিলনাড়ু। এ সব রাজ্যে ভাঙতে হবে আঞ্চলিক দলকে, বিভাজন নীতি প্রয়োগ করতে হবে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে। অতএব জয় পন্ডাকে বিজেডির ভিতর রেখে তাঁকে অক্সিজেন জোগাও নবীন-বিরোধী বিদ্রোহে, তামিলনাড়ুতে তো এআইডিএমকে দু’টুকরো হয়েই গেছে। এ বার দল ভেঙে বিজেপির তামিল সংস্করণ গড়ে তোলো। তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় সভ্যতায় ভুল করেও রামনাম নিয়ো না। কৌটিল্য বলেছিলেন সাম-দান-দণ্ড আর ভেদ নীতির কথা। অমিত শাহের বৈঠকখানায় ওঁর মাথার কাছে আছে কৌটিল্যের ছবি। নীতীশ কুমারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার সাম-নীতি। শিবসেনা আর চন্দ্রবাবু নাইডু এমনকী মেহবুবা মুফতির পিডিপিকে দাননীতি অর্থাৎ পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে ঘায়েল করো। দাবার চালে দণ্ডনীতির প্রয়োগ করো মায়াবতী-মুলায়ম, এমনকী তৃণমূলের ওপর— সিবিআই আর এনফোর্সমেন্ট। আর সর্বশেষ নীতি হল ভেদ। ভেঙে দাও। বিজেডি ভাঙো। এসপি ভাঙো, অপর্ণা যাদবকে দরকার হলে মন্ত্রী করে দাও। কংগ্রেস থেকে এন ডি তিওয়ারি, জাফর শরিফ ইত্যাদি ইত্যাদি।
সত্যি বলতে কী, এগুলো কোনওটাই নতুন নয় বিজেপিতে। আডবাণীর সময়েও তৃণমূল কংগ্রেস ভাঙার চেষ্টা করা হয়নি? চন্দ্রবাবু নায়ডু চাননি, কিন্তু প্রয়াত ইয়েরান নাইডুকে দিল্লিতে মন্ত্রী করার টোপ দেওয়া হয়। এমনকী বিজেডি ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। কংগ্রেস নেতা কে সি পন্থ, কুমারমঙ্গলম, সুখরাম, বুটা সিংহ প্রমুখকে দলে আনার প্রক্রিয়া তো শুরু করেছিলেন আডবাণী নিজেই।
তাই অমিত শাহের রাজনীতি আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন লাগছে না। তফাত একটাই। সে দিন কৌশলে একটা স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। এখন তো দাঙ্গাও পরিকল্পিত। হলিউডের ছবিতে যেমন দেখায়, সিআইএ-র ওয়র রুম থেকে শীর্ষ গোয়েন্দারা বড় পর্দায় দেখছেন সুদূর তুরস্কতে কী ভাবে এক এজেন্ট প্রোভোকেটর বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছেন কোনও ভিড়-বাজারে, ঠিক সে ভাবে বর্তমানের বায়োলজিক্যাল ট্রে-তে ভবিষ্যতের ভ্রুণের জন্ম দেওয়া হচ্ছে অসাধারণ মুন্সিয়ানার সঙ্গে।
তেত্রিশ বছর আগে বৌবাজারে প্রয়াত সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, প্রবীণ এক সাংবাদিক আমাকে বলেছেন আপনাদের বলা হয় ভারতীয় কৌশল পার্টি। কিন্তু কেন?
জবাবে বিশ্বনাথবাবু বলেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে দুটি শব্দ পৃথক। স্ট্র্যাটেজি আর ট্যাকটিক। স্ট্র্যাটেজি তৈরি হয় মতাদর্শের ভিত্তিতে। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার রাস্তা হল কৌশল। আজ এত বছর পর মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে বড় কৌশল পার্টি হল ভারতীয় জনতা পার্টি। সিপিআই ওদের কাছে শিশু। দিল্লির অজয় ভবনের সিমেন্টের দেওয়ালে গাছ গজিয়েছে। অর্থাভাবে রং হয়নি কতদিন। ভাগ্যিস বিশ্বনাথবাবুকে এই আধুনিক কৌশল পার্টির রাজনৈতিক সাফল্য দেখে যেতে হয়নি।