দিকে দিকে বার্তা রটিয়া গেল, এবং তৎক্ষণাৎ সকল বিজেপি নেতা ‘চৌকিদার’ হইয়া গেলেন। কোনও যোগ্যতা বা পরীক্ষার প্রয়োজন হয় নাই। কেবল টুইটার অ্যাকাউন্টে নামের পূর্বে ‘চৌকিদার’ বসাইলেই হইল। বর্তমানে বিজেপির চরিত্র হইল, মধ্যাহ্নে প্রধানমন্ত্রী যাহা বলেন, অপরাহ্ণে তাহা বলেন সভাপতি, এবং সায়াহ্নে সমস্বরে তাহার পুনরাবৃত্তি করিতে থাকেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হইতে পুরসভার কাউন্সিলর— সকল সদস্য। অতএব, প্রধানমন্ত্রী চৌকিদার হইলে অবশিষ্ট সদস্যদেরও রাতারাতি তাহা হইয়া উঠা দস্তুর। ঘটনা হইল, রাফাল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে বিঁধিতে গিয়া কংগ্রেস সভাপতি স্লোগান তুলিয়াছিলেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। কারণ ক্ষমতায় আসিবার পর বারংবার দেখা গিয়াছে, আপনাকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে অপর কোনও সম্বোধনেই অধিক স্বচ্ছন্দ নরেন্দ্র মোদী। কখনও প্রধান সেবক, কখনও মজদুর, কখনও আবার চৌকিদার। তৎসূত্রেই এই ব্যঙ্গের আমদানি। তবে ধেয়ে আসা বাণের অভিমুখ ঘুরাইয়া দিবার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ অভিশাপকে আশীর্বাদে পরিণত করিতে চাহিয়া প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলিলেন (এবং সকলকে দিয়া বলাইলেন) ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’।
তবে, মূল স্লোগান এবং পাল্টা স্লোগানটির চরিত্রে কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। পার্থক্যটি প্রাথমিক ভাবে ব্যাকরণগত। বিরোধী দল যখন স্লোগান তুলিয়াছিল, তখন চৌকিদার ছিল কেবলই বিশেষ বিশেষ্য। অর্থাৎ চৌকিদার বলিতে কাহাকে নিশানা করা হইতেছে, ইহা বুঝিতে দ্বিতীয় বার ভাবিতে হয় নাই। তবে শাসক যখন সকলকে চৌকিদার বানাইয়া তুলিল, তখন উহা অবশ্যই সাধারণ বিশেষ্য হইয়া গেল। হিসাব গুলাইয়া গেল— কে চৌকিদার? আপন বক্তব্যকে জোরালো করিতে বাস্তবের পঁচিশ লক্ষ চৌকিদারকে লইয়া অডিয়ো কনফারেন্সও করিয়া ফেলিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিষ্ঠা করিবার চেষ্টা হইল, চৌকিদারদের অপমান করিতেছে বিরোধী দল। এমনকি, জনতাকেও রণাঙ্গনে নামাইয়া দিল শাসক। ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ পণ্যের বিক্রয়ও নাকি শুরু হইবে। জনতাও যদি চৌকিদার হইয়া উঠে, তবে বিরোধীদের চোখে তাহাদের চোরও হইতে হইবে— দুইটি যে সমার্থক। সুকুমার রায় থাকিলে বলিতে পারিতেন ‘তুই চৌকিদার না মুই চৌকিদার’!
দিনের শেষে হাতে কী রহিল? রাজনীতির প্রভূত লাভ। হয়তো বিজেপির বিরুদ্ধে ‘চুরি’র অভিযোগ কিঞ্চিৎ লঘু হইল। হয়তো এক তরফা বিরোধী আক্রমণ যে ভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করিতেছিল, তাহা বহুলাংশে ভোঁতা হইল। হয়তো নির্বাচনী দৌড়ে নরেন্দ্র মোদী কিয়দংশে আগাইয়া গেলেন। কিংবা এই সকল কিছুই হইল না। তবে, উহার অধিক গুরুত্বপূর্ণ, নীতির প্রভূত ক্ষতি। যে স্লোগানে কোনও বিশেষ পেশাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় নাই, যে স্লোগান ছিল কেবল প্রধানমন্ত্রীকে ব্যঙ্গ করিবার উদ্দেশ্যে, তাহাতে সুকৌশলে একটি পেশাকে জুড়িয়া লওয়া হইল, এবং দিনের শেষে অপমানটি তাঁহাদেরই বিঁধিল। ইহা অধিক স্পষ্ট করিয়াছেন বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, বলিয়াছেন ‘‘আমি ব্রাহ্মণ অতএব চৌকিদার হইব না।’’ এমনিতেই ভারতে কায়িক শ্রমের পেশার সম্মান নাই। আপনাকে কুশলী প্রমাণ করিতে ফের তাহাকে ভূলুণ্ঠিত করিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। ইহার অধিক দুর্ভাগ্য আর কী হইতে পারে?