সম্পাদকীয় ১

কেবল সঙ্কীর্ণ স্বার্থ

বিজেপির তরফ হইতে সরকার ভাঙিবার কারণ দর্শানো হইয়াছে জঙ্গি হানার তীব্রতা বৃদ্ধি। কোনও সন্দেহ নাই, জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যক্রম যে ভাবে বাড়িতেছে, তাহা উপত্যকার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করিবার পক্ষে যথেষ্ট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৮ ০০:২৪
Share:

জোট ভাঙিয়া জম্মু ও কাশ্মীরে সরকার ফেলিয়া ভারতীয় জনতা পার্টি প্রমাণ করিল, সরকার গড়া-ভাঙা দুই কাজেই তাহাদের এক ও একমাত্র নির্দেশিকা, দলীয় স্বার্থ। রাজ্যের স্বার্থ নয়। ভোটারদের স্বার্থ নয়। যে জাতীয় স্বার্থের নামে বিজেপি রাত্রিদিন শপথ লয়, তাহাও নয়। সরকার ভাঙিবার জন্য যে মুহূর্তটি তাহারা বাছিয়া লইল, সেই সময় নির্বাচনই এ কথা বলিয়া দেয়। সেনাকে পুরাদস্তুর ‘স্বাধীনতা’ না দিলে উপত্যকাকে বাগে আনা যাইবে না, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা উচ্চারণ করিবার পর পরই যখন রাজ্যপাল শাসন জারি হয়, পাঁচে পাঁচে দশ, হিসাব মিলাইতে কষ্ট হয় না। রাজ্যপালের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে বকলমে সেনা শাসন চালাইলে রাজ্য বা রাজ্যবাসীর কিছুমাত্র সুবিধা হইবার কথা নয়। রমজানের এক মাস কাটিতেই যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহারের বাসনা চাউর করিয়া নির্বাচিত সরকার ভাঙিয়া দিলেও রাজ্যবাসীর স্বার্থরক্ষার দাবি তোলা যায় না। কাশ্মীরকে প্রাত্যহিক বধ্যভূমি করিয়া যুদ্ধ-যুদ্ধ জিগির তুলিলে, পাকিস্তানকে নিশানা করিয়া অহর্নিশি তোপ দাগিলে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক পুষ্ট হইতে পারে, কিন্তু দেশের সর্বাঙ্গীণ স্বার্থ (কিংবা, সবকা সাথ-এর আদর্শ) পূরণ হইতে পারে না। অর্থাৎ কেবল দলীয় ভোটভাণ্ডারের সমৃদ্ধির লক্ষ্যেই জম্মু ও কাশ্মীরের মতো এত সংবেদনশীল প্রদেশে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল। ২০১৯ সাল আসিতে বিলম্ব নাই, দলের আখের গুছাইতে ব্যস্ত বিজেপি। প্রসঙ্গত, গত কয়েক মাসে পদে পদে বিজেপির সহিত বিরোধ বাধিলেও সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি কিন্তু সরকার হইতে বাহির হইতে চাহেন নাই জনগণের কথা মাথায় রাখিয়াই। আকস্মিক ভাবে সরকার ভাঙিয়া গেলে রাজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হইবে, এই আশঙ্কা মুফতি অনেক বার ব্যক্ত করিয়াছেন। বিজেপি বাদ সাধিল। ২০১৫ সালের পয়লা মার্চ সব রকম আদর্শ-বিভেদ টপকাইয়া একেবারে ভিন্ন মেরুর দল পিডিপির সহিত হাত মিলাইয়া সরকার গড়িবার সময়ও বিজেপির অতি উদ্‌গ্রীবতা দেখা গিয়াছিল। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার ফেলিবার সময় সেই উদ্‌গ্রীবতা যেন আরও কয়েক ডিগ্রি বেশি।

Advertisement

বিজেপির তরফ হইতে সরকার ভাঙিবার কারণ দর্শানো হইয়াছে জঙ্গি হানার তীব্রতা বৃদ্ধি। কোনও সন্দেহ নাই, জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যক্রম যে ভাবে বাড়িতেছে, তাহা উপত্যকার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করিবার পক্ষে যথেষ্ট। গত এক মাস যুদ্ধবিরতি চলাকালীনও জওয়ানদের উপর বার বার হামলা চলিয়াছে, নিহত হইয়াছেন একাধিক জওয়ান। সাংবাদিক শুজাত বুখারি ও তাঁহার রক্ষী নিধনের জন্য কে বা কাহারা দায়ী, তাহা অবশ্য এখনও প্রমাণিত হয় নাই। সব মিলাইয়া কাশ্মীর ক্রমশই সংঘর্ষ-বুলেট-রক্তক্ষয়ের আবর্তে তলাইবার পথে। ইহার দৃঢ় মোকাবিলা জরুরি। এখন, প্রশ্ন এই যে, দৃঢ়তার একমাত্র অর্থ কি বুলেটের পরিমাণ সীমাহীন ভাবে বাড়াইয়া যাওয়া? তর্ক উঠিতে পারে যে গত দুই বৎসর ধরিয়া সেনা-অভিযান বৃদ্ধি ও জঙ্গি দমনের নামে নাগরিক সমাজের যে শ্বাসরোধ ঘটানো হইয়াছে, তাহাও কি উপত্যকার সঙ্কট চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়াইবার কারণ নহে? দ্বিতীয়ত, সরকার ভাঙিলে যে ‘মোকাবিলা’ উত্তম হইবে, এই ভাবনার পিছনে যুক্তিটি কী? পিডিপি-নেত্রী মেহবুবা জঙ্গিদের সক্রিয় সাহায্য করিতেছিলেন, এমন অভিযোগ কি বিজেপিও তুলিতে পারে? যেখানে সেনাবাহিনী চব্বিশের জায়গায় ছাব্বিশ ঘণ্টা সক্রিয়, সেখানে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন, সে যে দলেরই হউক— তাহারা যে কাজ করিতে অসুবিধা বোধ করিবে, ইহাই তো স্বাভাবিক। পিডিপি বরং একটি মধ্যস্থকারীর ভূমিকা পালন করিতেছিল। বিজেপি নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত বুঝাইয়া দিল— সঙ্কীর্ণ স্বার্থের খাতিরে মধ্যস্থকে সরাইয়া দিতে তাহারা দেরি করিবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন