নশ্বর পৃথিবীতে নশ্বরতম বস্তু হইল রাজনৈতিক শরিকদের বন্ধুতা। এই সার সত্যটি বোধ হয় এত দিন বিস্মৃত হইয়া বসিয়াছিলেন নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ। উপনির্বাচনে দলের ধরাশায়ী অবস্থা দেখিয়া হঠাৎ তাঁহাদের চিত্তপটে নূতন করিয়া কথাটি উদ্ভাসিত হইল। অমিত শাহের এখন বিষম বিপদ: হাতের আর সব কাজ ফেলিয়া দৌড়াইতে হইতেছে শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরের কাছে। শিবসেনা যে বিজেপির কত বড় ‘বন্ধু’, তাহা মনে করাইয়া দিতে হইতেছে। অথচ গত ফেব্রুয়ারি মাসেই যখন এই উদ্ধব ঠাকরে বিষম বিক্ষুব্ধ হইয়া বলিয়াছিলেন, বড়র পিরিত বালির বাঁধ বলিয়াই তাঁহাদের প্রতি বিজেপির এত অবহেলা, বিজেপি কেন্দ্রে নিজের ক্ষমতার গৌরবে রাজ্যে শরিকদের পদানত করিয়া রাখিতে চাহিতেছে, গত এপ্রিল মাসে যখন শিবসেনার পক্ষ হইতে সম্পর্কবিচ্ছেদের ইচ্ছাটি শোনা গিয়াছিল, অমিত শাহ মোটেই সেই সকল কথায় কান দেন নাই। যখন শিবসেনা মহারাষ্ট্রের আদিবাসী-কৃষকদের বুলেট-ট্রেনবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিতে সদলবলে নামিয়া পড়িয়াছিল, তখনও বিজেপি নেতৃত্ব ভাবিয়াছিলেন, দণ্ডের দাপট হইল শেষ কথা, শিবসেনাকে দমাইতে তাঁহাদের কিছুমাত্র অসুবিধা হইবে না। ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে, শরিকদের দমাইবার ভাবনা দিয়া শরিকদের কাছে টানা একটু মুশকিল। যুদ্ধের সময় শরিকদের সাহায্য পাইতে হইলে শান্তির সময়ই শরিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জরুরি। এই বিরাট ভুলের মাসুল দিতে হইল একের পর এক উপনির্বাচনের পরাজয়ে, এবং যে উপনির্বাচনে বিজেপি জিতিয়াছে, সেখানেও জয়ের ব্যবধান বিরাট ভাবে কমিয়া যাওয়ার ফলে। দুর্ব্যবহার দিয়া কী ভাবে বন্ধুকে শত্রু করিয়া দিতে হয়, বিজেপি-শিবসেনা সম্পর্কের সাম্প্রতিক কাহিনি তাহার দৃষ্টান্ত।
দৃষ্টান্ত আরও অনেক আছে। পঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দল পরিষ্কার বলিয়া দিয়াছে, আগামী বৎসরও যদি তাহাদের সাহচর্য বিজেপির দরকার হয়, দাদাগিরির অভ্যাসটি হইতে বাহির হইয়া আসিতে হইবে। শিবসেনার মতো তাহাদের বিজেপির সহিত একই পরিসরে লড়াই করিতে হয় না, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও রাজ্যে প্রতিটি বিষয়ে বিজেপির দাদাগিরির চাপে তাহারা ক্লান্ত। অন্ধ্রের তেলুগু দেশমের সহিত সংঘর্ষের দামটি বিজেপিকে ইতিমধ্যেই অনেকখানি দিতে হইয়াছে। এ বার বিহার হইতেও ধ্বনিত হইল বিক্ষোভের সুর, ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের প্রত্যয়। এনডিএ শরিক জেডি(ইউ)-এর নূতন অবস্থান— নীতীশ কুমারকেই অতঃপর রাজ্যে এনডিএ জোটের ‘মুখ’ করিতে হইবে। হাতি কাদায় পড়িলে শরিকরা মজা পাইয়া যায়, বিশেষত যখন হাতির মেজাজ তাহাদের এত দিন সহ্য করিতে হইয়াছে।
মনে করিবার কারণ আছে যে, অতি দর্পেই বিজেপি এত দিন শরিকদের এতখানি অবজ্ঞার দুঃসাহস করিয়াছে। গত লোকসভা নির্বাচনের অপ্রত্যাশিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে মোদী-শাহের মাথা ঘুরাইয়া দিয়াছিল, অনেক ক্ষেত্রেই তাহার সঙ্কেত মিলিয়াছে। শরিক-নীতিতেও সেই একই অহং-বাদের প্রকাশ। প্রাক্তন বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময় এনডিএ-শরিকদের লইয়া নিয়মিত বৈঠকে বসিত বিজেপি। এমন বৈঠকের কথা মোদী বা শাহ সম্ভবত ভাবিতেও পারেন না। বাজপেয়ীর সহিত বহু বিষয়েই মোদীর অমিল, কিন্তু রাজনৈতিক কৌশলের প্রয়োজনেও যে তিনি ও তাঁহার সেনাপতি অমিত শাহ পূর্বসূরির পথের মূল্য ভাবিয়া দেখেন নাই, ইহাই আশ্চর্য। অনেক সময় তো কৌশলের প্রয়োজনেও দরাজ হইবার ভান করিতে হয়। এই সামান্য কথাটি যাঁহারা বোঝেন না, তাঁহারাই এই মুহূর্তে দেশের অগ্রগণ্য রাজনৈতিক কৌশলী? ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দিতে পারে, কিন্তু শরিকরা বগার কান্না শুনিতে চাহিবে কি?