যোগী আদিত্যনাথরা এ বার বাকি দেশ ‘পুনরুদ্ধারে’ তৎপর

রথ নয়, অযোধ্যা থেকে ছুটল অশ্বমেধের ঘোড়া

সব যাত্রা দেখতে এক হলেও চরিত্রে এক নয়। কেনই বা হবে। ১৯৯০-এর বিজেপি আর ২০১৮-র বিজেপি কি এক? দশক পালটেছে, শতক পালটেছে, বিরোধী দল কেন্দ্রীয় শাসক হয়েছে, সংসদে ২৮২ আসনে ছাতি ৫৬ ইঞ্চি হয়েছে।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০১
Share:

রাষ্ট্রকর্ম: ‘জল মিট্টি রথ যাত্রা’র উদ্বোধন করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, দিল্লি, ১৪ ফেব্রুয়ারি। ছবি:পিটিআই

সে বার ছিল গুজরাতের সোমনাথ থেকে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা। আর এ বার সোজা উত্তরপ্রদেশ থেকেই শুরু। সেখান থেকে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক হয়ে তামিলনাড়ু— রামেশ্বরম। আটাশ বছর পর এ বার তা হলে ‘উলটো রথ’। শুধু দিক হিসাবে উলটো নয়, মিথ হিসাবেও উলটো বলতে হবে। রাম তো লঙ্কা জয় করে রাজ্যাধিকার ফিরে পেতে দক্ষিণ থেকেই উত্তরে এসেছিলেন বলে জানা আছে।
এ বার ব্যাপারটা তবে অন্য রকম। ট্রাক-রথে গৈরিক পতাকা উড়িয়ে তিনি চলেছেন উলটো দিকে। উত্তর থেকে দক্ষিণে, রাজধানী থেকে উপকূলে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তে। রাজ্যাধিকার এখন তাঁর কবজায়, সেটা কেবল পোক্ত করা উদ্দেশ্য এ বার।

Advertisement

অর্থাৎ, সব যাত্রা দেখতে এক হলেও চরিত্রে এক নয়। কেনই বা হবে। ১৯৯০-এর বিজেপি আর ২০১৮-র বিজেপি কি এক? দশক পালটেছে, শতক পালটেছে, বিরোধী দল কেন্দ্রীয় শাসক হয়েছে, সংসদে ২৮২ আসনে ছাতি ৫৬ ইঞ্চি হয়েছে। এখন দরকার, গোটা দেশকে নিজের ক্ষমতা বিষয়ে ভাল করে সমঝে দেওয়া। রামভক্তদের হাতে রাজ্য না থাকলে যে মানুষের হাঁড়ির হাল হবে, সেটা মনে করিয়ে দেওয়া। সেই অর্থে এটা ঠিক রথযাত্রা নয়। বরং অশ্বমেধ যাত্রার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে।

আর, সেই জন্যই এ বার, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রথের শুভযাত্রার সূচনায় দিল্লির অনুষ্ঠানে এগিয়ে এলেন— কোনও নেতা নন, কোনও সাধু নন, স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ঘোষণা করলেন, দেশের কল্যাণের জন্য দেবাশীর্বাদ পেতেই এই অভিযান। দেশের জন্য মন্ত্রীর কপালে উদ্বেগের ভ্রুকুঞ্চন: দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আজকাল একের পর এক আঘাত, জম্মু-কাশ্মীরে হানা, পাকিস্তান আর চিনের সীমানা পেরোনো স্পর্ধা। একটা স্বস্ত্যয়ন ছাড়া দেশ নিরাপদ হবে কী করে। তাই রথ চলল চার দিক ঘুরে ধুলো মাটি জল সংগ্রহ করতে— কাশ্মীর থেকে ডোকলাম থেকে রামেশ্বরম। এর পর দেখা যাবে কী করে নষ্টামি করে কুলোকের দল।

Advertisement

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দুশ্চিন্তা যে খুবই গভীর, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। জম্মু ও কাশ্মীরে সরকারি গোয়েন্দারা বার বার ব্যর্থ হচ্ছে খবরাখবর দিতে, জঙ্গিদের দাপটও গত তিন বছরে ভালমত বেড়েছে, একের পর জওয়ান-নিধনের খবর আসছে— সমাধান হিসাবে ‘জল-মিট্টি-রথযাত্রা’র কথাই বলছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গেরুয়া পতাকা হাতে নিয়ে রাজনাথ সিংহের উদ্বেলিত ঘোষণা: এই রথযাত্রা সব দেশকে জানিয়ে দেবে, ভারতই ‘বিশ্ব গুরু’।

যাত্রার শুরুতে তাঁর মুখেই শোনা গেল, কেন এই রথযাত্রা অন্যান্য বারের চেয়ে আলাদা। এ বার উদ্দেশ্যটা ‘আরও বড়’। লক্ষ্য এখন, ভারত নামক জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা, শক্তিশালী করা: ‘উই ওয়ন্ট টু সি আওয়ার কান্ট্রি অ্যাজ ইনডিপেন্ডেন্ট, স্ট্রং অ্যান্ড প্রসপারাস।’ ত্যই তো, রথ ছাড়া এ কাজে অগ্রসর হওয়া যেতই বা কী করে।

১৯৯০ সালের রথযাত্রার সময় মন্দির তৈরিই ছিল আসল কথা। দু’বছরের মাথায় ভেঙেছিল বাবরি মসজিদ। ১৯৯২-এর সেই ‘এক ধাক্কা অওর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’র ম্যাজিকই তো বিজেপির পরবর্তী দেশজোড়া সাফল্যের প্রধান স্তম্ভ। সাহস করে ‘এক ধাক্কা’ দিলে যে তার ফল কত দূর গড়াতে পারে, সেটা প্রমাণিত হয়েছে এত দিনে। রামমন্দির নিয়ে এখনও মামলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে ভাঙনযজ্ঞের কোনও বিচার নেই, ভাঙল যারা তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নেই, বরং ভাঙা হয়ে গিয়েছে যে মসজিদ, সেই জায়গায় কী হবে, এইটাই মামলার মূল উপজীব্য। অর্থাৎ গল্পটা পালটে গিয়েছে। মন্দিরের জন্য যে মসজিদ ভাঙতে হতেই পারে, এটা দেশের বেশির ভাগ মানুষই স্বীকার করে ফেলেছেন। ২০১০ সালে ইলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়েও যেন সেই ধারণারই ছায়া। হাই কোর্টের রায় ছিল— বিতর্কিত জমিকে তিন ভাগ করে নিয়ে এক ভাগ নির্মোহী আখড়া, এক ভাগ রামলালা ও আর এক ভাগ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের অধিকারে যাবে।

তার মানে, রামমন্দির বিতর্কে বিজেপির অর্ধেকটা জয় এসেই গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়টুকু আসা কেবল বাকি। কত তাড়াতাড়ি মন্দিরটি বানানো যায় ওই জমিতে, তার ব্যবস্থা। তাই সুপ্রিম কোর্টে যতই ‘এ মামলা জমির অধিকারের প্রশ্ন’ ইত্যাদি বলা হোক না কেন, বিজেপি বা সংঘে কারও কোনও সন্দেহ নেই যে, মন্দির শেষ পর্যন্ত হবেই। তাই না একেবারে নিখুঁত দিনক্ষণ মেপে পরিকল্পনা। করসেবকপুরম থেকে এ বার যাত্রা শুরু, যে শহরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের সদর দফতর, যে শহরে করসেবকরা সেই ১৯৯০ সাল থেকে ওয়ার্কশপ-এ রামমন্দিরের স্তম্ভ বানিয়ে চলেছেন— এক দিন তাঁদের স্বপ্নের মন্দিরে সেগুলি স্থাপিত হবে বলে। ফেব্রুয়ারির ১৩ থেকে মার্চের ২৩ অবধি ৩৯ দিন ধরে চলবে এই রথযাত্রা। এই যাত্রায় যে-সব পবিত্র ‘মাটি ও জল’ সংগ্রহ করা হবে, তা দিয়ে মার্চের ১৮ থেকে ২৫ তারিখ দিল্লিতে লালকেল্লার কাছে অনুষ্ঠিত হবে মেগা স্কেলের ‘রাষ্ট্র রক্ষা মহাযজ্ঞ’। ১০৮টি ‘হবন-কুণ্ড’ বসানো হবে, ২১০০ পুরোহিত ও ৫১০০০ ভক্ত পুজো করবেন, সব কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা থাকবেন, নেতারা তো বটেই।

ওই মার্চেই রামমন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের শেষ শুনানি। রায় বার হতে আর কিছু মাস। তার পর, যেই না রায় বেরোবে— অমনি জাতীয় ভোট। পাবলিক মুডকে এই ভাবেই কাজে লাগাতে হয়। রামমন্দিরের নামে রথ যদি সারা দেশ ঘুরে ‘জনাশীর্বাদ’ জোগাড় করে নিয়ে আসে, রথের আনা জল-মাটি দিয়ে রাষ্ট্রসুরক্ষার পুজো হয়, আইন-আদালত কি পারবে এত মানুষের ভক্তি আর প্রেরণার জোরকে উপেক্ষা করতে? দেশে ‘গণতন্ত্র’ বলে কিছু নেই?

এই ভাবে দেখলেও এ বারের রথযাত্রার উদ্দেশ্যটা রীতিমত ‘বড়’। বিজেপি বুঝিয়ে দিতে চায়, আদালত যা বলে সেটাই শেষ কথা, এটা ভাবার দরকার নেই। তাঁদের নতুন ভারতে রামমন্দির হবে কি না, দেশের মানুষের আবেগেই তা ঠিক হবে, বিচারকরা ঠিক করবেন না। অর্থাৎ মন্দিরের প্রশ্নটা ‘লিগাল’ বা আইনি বিষয় নয়, ‘আইডিয়োলজিকাল’ বা ভাবাবেগের বিষয়। ভাবাবেগ বলতে অবশ্যই সংখ্যাগুরুর ভাবাবেগ। সংখ্যাগুরু ছাড়া বাকি যাঁরা আছেন, তাঁদের আবার ভাবাবেগ কী। যদি তেমন কিছু থেকেও থাকে, সেই অবাঞ্ছিত ভাবাবেগের ওষুধ বিজেপির পকেটে। রথযাত্রার অবধারিত সঙ্গী মুসলিম-পিটুনি: নব্বই সালের যাত্রাপথই তা মনে করিয়ে দেয়। রথ সে বার যতগুলো শহরে ঢুকেছিল সর্বত্র দাঙ্গা হয়েছিল, জারি হয়েছিল কারফিউ। গুজরাতে শ-খানেক, জয়পুরে ৫২, জোধপুরে ২০, আগরায় ৩১, কানপুরে ৩০ এবং লখনউয়ে ৩৩ জন নিহত হন। নিহতের সংখ্যার পাশে প্রতি ক্ষেত্রে লেখা হয় ‘মোস্টলি মুসলিমস’। এ বারের অভিজ্ঞতা আলাদা হবে কি?

২০১৮-র রথযাত্রার উদ্দেশ্য ও বিধেয় যে ভেতরে-ভেতরে ‘বড়’, একটু অন্য ভাবেও সেটা বোঝা যেতে পারে। ১৯৯০-এর যাত্রা যে সোমনাথ থেকে শুরু হয়েছিল, তার কারণ, গজনির মাহমুদ নামক ‘মুসলিম আগ্রাসনকারী’র দাপটে যে সোমনাথের মন্দির ভাঙা হয়, এবং স্বাধীন ভারতে সর্দার পটেলের সৌজন্যে (নেহরুর অমতেই) যে মন্দির কোটি কোটি টাকা দিয়ে পুনর্নির্মিত হয়— সেখান থেকে অযোধ্যার দিকে যাত্রা শুরু করে লালকৃষ্ণ আডবাণীরা বোঝাতে চেয়েছিলেন, একই ভাবে তাঁরা রামজন্মভূমিরও পুনরুদ্ধার করবেন।

অর্থাৎ রথযাত্রা একটা ‘পুনরুদ্ধার’-এর আখ্যান। আর, ২০১৮-র রথযাত্রায় রাজনাথ সিংহ বা যোগী আদিত্যনাথরা বলতে চাইছেন, অযোধ্যার কাজ মোটের উপর শেষ, এ বার তাঁরা চলেছেন বাকি দেশের ‘পুনরুদ্ধারে’। সব মন্দির পুনর্নির্মাণ না করা গেলেও, সব অহিন্দু অর্থাৎ ‘আগ্রাসনকারী’কে তো নিশ্চয়ই একটা কঠোর বার্তা দেওয়া সম্ভব!

রাম তো শুধু দেশ শাসন করেননি। যুদ্ধও করেছিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন