নিজুক মিঠাই আর বিকাশ-ইউনিসদের বগড়ির দোল

অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রাচীন দোলগুলোর অন্যতম। দোলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা লোকগাথা। ধর্ম এবং বর্ণভেদের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। বগড়ির দোলে রাঙালেন রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য কথিত আছে, মধ্যম পাণ্ডব ভীম বনবাসকালে বগড়িতে বকাসুরকে বধ করেছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৯ ০৭:১০
Share:

থান: কৃষ্ণনগরে শ্রীকৃষ্ণরায়জীউয়ের মন্দির। নিজস্ব চিত্র

প্রাচীনত্ব নিয়ে নিঃসন্দেহ। নথিপত্রের প্রমাণ দেবেন মানিকরাম গাঙ্গুলি। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ধারার কবি। তাঁর ধর্মমঙ্গলের কাব্যে মেলে বগড়ির কৃষ্ণরায়ের বন্দনা। বন্দনা অংশে মানিকরাম লিখছেন, ‘সরস হৃদয়ে বন্দি বগড়ির কৃষ্ণরায়।/নিরবধি ঘর্ম তার শ্রীঅঙ্গে চুয়ায়’। কিংবদন্তীতে কৃষ্ণরায় আরও প্রাচীন। তাঁর যোগ মহাভারতের কালের সঙ্গে।

Advertisement

কথিত আছে, মধ্যম পাণ্ডব ভীম বনবাসকালে বগড়িতে বকাসুরকে বধ করেছিলেন। খুশি হয়ে শ্রীকৃষ্ণ বগড়িতে এসে পাণ্ডবদের অভিনন্দন জানান। তাঁর আগমনের স্মারক হিসাবে যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন শিলাবতী নদীর উত্তর দিকে। অন্য কাহিনি বলে, কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের কাছে তাঁর স্ত্রী ঊষা শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে জানতে চান। কিন্তু কৃষ্ণের রূপ অনিরুদ্ধ বোঝাতে অক্ষম হন। অনিরুদ্ধের নির্দেশে কয়েকজন শিল্পী শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি নির্মাণ করেন। দু’টি মূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের রূপ যথাযথ প্রকাশ পায়। কথিত, দুই মূর্তির একটি রয়েছে জয়পুরের মহারাজ মন্দিরে। সেই মূর্তি গোবিন্দজীউ নামে পরিচিত। অন্যটি বগড়ির এই শ্রীকৃষ্ণরায়জীউ।

তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হল, বগড়ির আইচ বংশীয় রাজা গজপতি সিংহের দেওয়ান রাজ্যধর রায় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজ্যধর রায় পুরীতে তীর্থ করতে গিয়ে এক ব্রাক্ষ্মণের কাছ থেকে কষ্টিপাথরের কৃষ্ণমূর্তি নিয়ে এসে বগড়িতে আনেন। রাজা গজপতি রায়ের আনুকূল্যে সেই বিগ্রহ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। শিলাবতীর নদীগর্ভে সেই মন্দির চলে যাওয়ায় সেখানে নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ইতিহাস এবং কিংবদন্তী ছাড়াও বগড়ির অনন্য বৈশিষ্ট্য কৃষ্ণরায় জীউয়ের দোলযাত্রা। এবং তাকে কেন্দ্র করে উৎসব।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দোলযাত্রার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বর্ণ এবং জাতি ভেদের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। অনেকে বলে থাকেন, সম্ভবত বগড়ির দোল মেদিনীপুরের প্রাচীনতম দোল। আর এই দোল সকলের। হিন্দুদের সঙ্গে দোল উৎসবে মাতেন মুসলমান ভক্তরাও। বগড়িরদোলের পরম্পরা এটাই।

দোলে সম্প্রীতির এই ছবি চলে আসছে কয়েকশ বছর ধরে। বগড়ির রাজা রঘুনাথ সিংহ ৭০ বছরের শাসনকালে বগড়িকে শক্তিশালী রাজ্য তৈরির চেষ্টা করেন। রঘুনাথ ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। রাজ্যের সীমানা সুরক্ষিত করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমদিকে তিনি শিলাবতী নদীর তীরে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখন রঘুনাথবাড়ি নামে পরিচিত। এই গ্রামে মাকড়া পাথরের একটি নবরত্ন মন্দির আছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রণব রায় তাঁর ‘মেদিনীপুর জেলার প্রত্ন-সম্পদ’ বইতে লিখেছেন, ‘কোনও লিপি না থাকলেও এই মন্দির খ্রিস্টীয় সতেরো শতকের শেষ বা আঠারো শতকের প্রথমে তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হয়’। এই মন্দিরের আসল বিগ্রহ বহুকাল আগেই চুরি হয়ে গিয়েছে। মন্দিরটি ঘিরেই গড়ে উঠেছে সম্প্রীতির মেলবন্ধন। কোনও এক বগড়ি রাজ মন্দিরের প্রহরী হিসাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছিলেন। সেই ব্যক্তিই মন্দিরের দেখভাল করতেন। যদিও এখন প্রহরী প্রথা নেই মন্দিরের। কিন্তু সেই প্রহরীর বংশধরেরাই রঘুনাথবাড়ি মৌজায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হন। এখন তাঁদের বাসস্থানের মাঝেই অবস্থিত এই মন্দির।

শিলাবতী নদীর দক্ষিণ তীরে রঘুনাথবাড়ির এই মন্দির চত্বরেই দোল উৎসবে মাতেন সকলে। রঘুনাথ সিংহের আমলেই উৎসবের সূচনা হয় বলে মত। কথিত আছে, তিনি মহা সমারোহে কৃষ্ণের বিগ্রহের পাশে রাধার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে বাসন্তী পূর্ণিমার দিন অভিষেক করেছিলেন। সেই থেকে প্রতি বছর বাসন্তী পূর্ণিমার দিন থেকে শুরু হয় দোল উৎসব। প্রথা মেনে তার আগের রাতে নদীর উত্তর তীরে কৃষ্ণনগরের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে নিয়ে চাঁচর উৎসব হয়। কৃষ্ণনগরে রাজা গজপতি সিংহের আনুকূল্যে চতুর্দশ শতকের নবম দশকে কৃষ্ণ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয়। নির্মাণ করা হয় মন্দির। শিলাবতীর নদী গর্ভে সেই মন্দির চলে যায় একসময়। বাংলা ১২৬২ সালে যাদব রাম চট্টোপাধ্যায় নামে এক কৃষ্ণভক্তের অর্থানুকূল্যে তৈরি হয় নতুন মন্দির। এখনও শিলাবতী নদীর তীরে কৃষ্ণনগরের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তিকে চতুর্দোলায় চাপিয়ে নগর পরিক্রমার মধ্য দিয়ে শুরু হয় চাঁচর। রাতভর চলে উৎসব। চতুর্দোলা কাঁধে নিয়ে পরিক্রমা করেন স্থানীয় দুলে সম্প্রদায়ের লোকজন।

এখানেই মেলে তথাকথিত বর্ণভেদ প্রথার ঊর্ধ্বে দোলের অবস্থান। বগড়ি কৃষ্ণনগরের শ্রীকৃষ্ণরায় জীউ মন্দির দেবোত্তর ট্রাস্টের সম্পাদক বিকাশ রায় বলেন, ‘‘স্থানীয় দুলে সম্প্রদায়ের লোকেরা সারাদিন উপবাস করে যুগলমূর্তিকে চতুর্দোলায় চাপিয়ে এলাকা পরিক্রমা করেন, এঁরাই পালকির বেহারা।’’ এই কাজে বেশ কয়েক বছর ধরে যুক্ত হেলু দুলে। তিনি বলেন, ‘‘পূর্বপুরুষেরা দোল উৎসবের আগে চাঁচরের সময় চতুর্দোলা নিয়ে পরিক্রমা করার এই দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন, আমরা সেই রীতি নিষ্ঠা ভরে বজায় রেখেছি।’’

দোল পূর্ণিমার দিন রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তিকে পালকিতে চড়িয়ে কৃষ্ণনগরের মন্দির থেকে নদীঘাট পেরিয়ে রঘুনাথবাড়ির মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। সেই সময় পথের দু’পাশে জনসমাগম ঘটে। ধর্ম নির্বিশেষে সকলে যোগ দেন সেই যাত্রা দর্শনে। মেলা সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গড়া হয়। সেটির সহ সম্পাদক ইউনিস খান। বছর সত্তরের ইউনিস খান বলেন, ‘‘বছর ১২-১৩ বছর ধরে আমি মেলা কমিটির সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে তো সম্পাদক ছিলাম, একসঙ্গে আমরা দোল উৎসবে মাতি, উপভোগ করি। এই সময় আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসেন। সারা বছর আমরা অপেক্ষায় থাকি এই সময়ের জন্য।’’ দোল মেলা কমিটির অন্য সদস্যেরা হলেন গোলাপ খান, হাতেম চৌধুরী, আখতার আলি খান প্রমুখ। সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে আছে মন্দির সংস্কার কমিটিও। এই কমিটির উদ্যোগে কয়েক বছর আগে রঘুনাথবাড়ির মন্দির সংষ্কার করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। মন্দির চত্বরে আবির খেলায় মেতে উঠেন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজন। মূল উৎসব তিনদিন ধরে চললেও মন্দির সংস্কারের পর দর্শনার্থীদের জন্য আরও এক সপ্তাহ মেলা থাকে। এই সময় রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহও থাকে রঘুনাথবাড়ির মন্দিরে।

মন্দির-বিগ্রহ নিয়ে কিংবদন্তী, সম্প্রীতির সুপ্রাচীন নিদর্শন ছাড়াও বগড়ির দোল আরও কিছু বিষয়ে আকর্ষণীয়। তা ভোগ আর মিষ্টান্নে। দোলের সময় কৃষ্ণ-রাধিকার সেবাপুজো হয়। আর এই সময়ে ভক্তদের মুখে মুখে ফেরে, ‘বগড়ির কৃষ্ণরায়/ হুড়কা খুলে মুড়কি খায়’। কারণ কৃষ্ণরায়ের জলসেবায় মুড়কি অন্যতম উপকরণ। জলসেবায় থাকে মুড়কি, লুচি, হুড়ুম, ছানা, মাখন। হুড়ুম হল চিড়ে ভাজা। সেই সঙ্গে থাকে মুড়কি। জলসেবায় হুড়ুম ও মুড়কি আবশ্যিক। এ সবের সঙ্গেই থাকে গুড়ের তৈরি একপ্রকার মিষ্টি, নিজুক মিঠাই। নিযুক্ত করা বা বন্দোবস্ত করা থেকেই এই নাম বলে জানা গিয়েছে।

দুপুরে হয় অন্নভোগ, রাতে শীতল ভোগ। শীতল ভোগেও থাকে হুড়ুম, নিজুক মিঠাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন