প্রবন্ধ ২

সামাজিক প্রশ্ন আজও এলেবেলে, কমরেড?

কমিউনিস্ট পার্টির জন্মকাল থেকেই ‘কে প্রধান শত্রু’, এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। আজও সেই ধারা বহমান। দেশের বাম আন্দোলনে কখনও কোনও সামাজিক প্রশ্নকে মুখ্য ভূমিকা নিতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।কমিউনিস্ট পার্টির জন্মকাল থেকেই ‘কে প্রধান শত্রু’, এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। আজও সেই ধারা বহমান। দেশের বাম আন্দোলনে কখনও কোনও সামাজিক প্রশ্নকে মুখ্য ভূমিকা নিতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

Advertisement

বোলান গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৫২
Share:

পাছে ভোট কমে। তসলিমা নাসরিন কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বামফ্রন্ট যুগে। কলকাতা, ২০০৮

গোটা দেশ যখন সামাজিক অবক্ষয় আর চিন্তার দৈন্যের সামনে দাঁড়িয়ে, তখন দেশের প্রধান বাম দলের প্লেনাম শুরু হল। প্লেনামের আলোচ্য সম্পর্কে অনেক সচেতন মানুষেরই প্রত্যাশা জাগা স্বাভাবিক। বিশেষত একুশ শতকের প্লেনাম, যখন নতুন প্রযুক্তি আর ভুবনায়নের হাওয়া এক নতুন দিকের ইঙ্গিত দিচ্ছে, সেই সঙ্গে নতুন সামাজিক সমস্যার সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। চিরাচরিত সমাধান আর খাটছে না। ন্যায় ও নীতি, দুইয়েরই সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে, সাধারণ মানুষ যদি প্রত্যাশা করেন যে, বামপন্থাও যুগোপযোগী হয়ে সমাধানের পথ খুঁজবে, সেটা কি খুব বেশি প্রত্যাশা?

Advertisement

কিন্তু উদ্বোধনী সভায় যখন সেই বহুপরিচিত মানুষদেরই দেখলাম, প্রথমেই একটু হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। এঁদের ভাবনাচিন্তা তো এতকাল ধরে শুনলাম। আবার সেই চর্বিতচর্বণ? বস্তুত কমিউনিস্ট পার্টির জন্মকাল থেকেই ‘কে প্রধান শত্রু’, এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। আজও সেই ধারা বহমান। নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়ছে বলেই, প্রধান শত্রু বাছাই করে কার হাত ধরা হবে সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। এমনকী, প্লেনামেও। যেন দেশে এর চেয়ে বড় আর কোনও সমস্যা নেই। যেন রাজনীতি মানে কেবল ভোট, সমাজের প্রতিফলন নয়।

বস্তুত, ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের বাম আন্দোলনে কখনও কোনও সামাজিক প্রশ্নকে মুখ্য ভূমিকা নিতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যে-কোনও রাজনৈতিক দলেরই প্রধান এবং প্রাথমিক কাজ হল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। বামেদেরও তা-ই। কিন্তু তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে থাকে সামাজিক প্রশ্নও। তার প্রতি দৃষ্টি ফিরবে কবে? মনে পড়ে, নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় যৌনকর্মীরা পেশাগত স্বীকৃতির দাবিতে পথে নেমেছেন, সমস্ত আন্দোলনের নেতৃত্বে কিন্তু প্রধানত এনজিও, তখন বামপন্থী নেত্রীকে প্রশ্ন করেছিলাম, এ বিষয়ে তাঁদের পার্টিগত অবস্থান কী? স্পষ্ট কোনও উত্তর দিতে পারেননি। কেবল এই বিষয় নিয়ে নয়, বিভিন্ন সামাজিক প্রশ্নেই দেখেছি, ওঁরা চুপ, পাছে ভোট কমে যায়! এই চুপ থাকার রাজনীতিই আজ ডালপালা মেলা বিষবৃক্ষটির মূলে। এক বার বাগবাজার স্ট্রিটে ধুমধাম করে হওয়া জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্বোধনে এক প্রথিতযশা বামপন্থী কবি ও পার্টির সদস্যকে দেখে তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, সেই দিনটি ছিল নভেম্বর বিপ্লব দিবস। কবির কৈফিয়ত হিসেবে শুনেছিলাম ‘জনগণের সঙ্গে থাকা’র তত্ত্ব।

Advertisement

এই বস্তাপচা থিয়োরিটির সঙ্গে আমার আশৈশব পরিচয়। আজও বুঝতে পারিনি, জনগণের সঙ্গে থাকতে গেলে নিজের বিশ্বাস মতো কাজ করা যাবে না কেন। জনসমক্ষে উল্টো কথা বলে বা কাজ করে জনগণকে সন্তুষ্ট করা যাবে— তাঁদের এত নির্বোধ ভাবারই বা কারণ কী? এক জন কবিই যদি নিজের বিশ্বাসে স্থির না হন, তা হলে মন্ত্রী-সান্ত্রিদের কথা তোলাই বৃথা। বামপন্থা যে কেবল একটা রাজনৈতিক কৌশল নয়, একটা জীবনচর্যা— তা ক’জন মান্য করেন? পৈতে গলায় দিয়ে নারায়ণশিলা পুজো না করে যিনি জল গ্রহণ করেন না, সেই মানুষটি যখন কর্মক্ষেত্রে গিয়ে বামপন্থী নেতা হন, তখন আশা করাই অন্যায় যে, সেই বামপন্থী আন্দোলনে দ্বিচারিতার ছায়া পড়বে না।

এক দিন বামপন্থী গণ-সংগঠনগুলি মানুষকে অন্য এক সাংস্কৃতিক জগতের সন্ধান দিতে পেরেছিল, দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা সেখানে আত্মপ্রকাশের পথ পেয়েছিলেন। ভোটবাক্সোকে মোক্ষ ভাবার পর থেকে সেগুলি হয়ে দাঁড়াল পার্টির শাখা-সংগঠন, ভোট টেনে আনার যন্ত্র, জীবিকা। আজ বোঝা যাচ্ছে, বাম ভোট মানেই সামাজিক অগ্রগমন নয়, তার জন্য আলাদা করে ভাবতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়, নিজেদের জীবনচর্যায় পরিবর্তন আনতে হয়। খুব সহজ কাজ নয়, অনেক সহজ দ্বিচারী দিনযাপন।

একটা সময় ছিল, যখন বামপন্থী পার্টিগুলি এত ভোট পেত না, তখনও মুসলমান এলাকায় মুসলমান প্রার্থী না দেওয়ার সাহস তারা তেমন ভাবে দেখাতে পারেনি। আবার, পাশার দান যখন উল্টে গেল— গাছ, পাথর যা-ই দাঁড়াক, বামপন্থী হলেই জিতবে— তখনও কিন্তু প্রার্থীর ধর্ম-পরিচয় দেখা বন্ধ হয়নি। এই কৌশলকে কি ধর্মনিরপেক্ষতা বলব? এটা কি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা নয়? বস্তুত, বামপন্থী আন্দোলনে হিন্দু মানসিকতা খুবই প্রকট ছিল, ‘আমরা-ওরা’র ভাগ ছিল বরাবর। কোনও দিন তার যথার্থ শুদ্ধিকরণ হয়নি। হওয়ার দরকার আছে বলে কেউ মনে করেননি। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ দাঁড়িয়েছিল পুজোর মাইকের সঙ্গে আজানের মাইকের পাল্লা দেওয়া।

বীরভূমের মেয়ে আয়েষা খাতুন। ছাত্রজীবনে কলকাতায় ছিলেন। সহপাঠী আর একটি মেয়ে, নিজেদের বাড়িতে ফাঁকা ঘরটি ভাড়া দেওয়া হবে বলে তাঁকে সম্ভাব্য ভাড়াটে হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত সেই মেয়েটির মা আয়েষাকে নিজের মেয়ের সঙ্গে যত্ন করে খেতে দিতেন, ভাল ব্যবহার করতেন। কিন্তু মুসলমান মেয়ে বাড়িতে থাকতে এসেছে শুনেই তিনি আঁতকে ওঠেন। ঘর ভাড়া দেন না। আয়েষা অবাক হননি। এ রকম তিনি অনেক দেখেছেন। কিন্তু তাঁর বন্ধুটি অবাক। তিনি তাঁর মা বা পরিবারকে এমনটা ভাবেননি, ছোটবেলা থেকে তাঁদের ‘প্রগতিশীল’ বলেই জেনে এসেছেন।

ভিতর আর বাহিরের এই দ্বিচারিতা নিয়েই আমাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। এই ভাগটা ভাঙার চেষ্টা না করে, বামপন্থীরাও তারই শিকার হয়েছেন। ব্যক্তিগত ধর্মাচরণকে মান্যতা দিতে গিয়ে ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপকে পুজো করেছেন। ব্যক্তিগত আর প্রাতিষ্ঠানিক গুলিয়ে গেছে, আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনও ফারাক থাকেনি। সামাজিক ‘ভিতর-বাহির’-এর ভেদরেখাটি নির্মূল করা খুব কঠিন কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই কারণেই তো কাজটায় জোর দেওয়া দরকার ছিল। তাঁরা কাজটিতে হাতই দেননি। দেননি বলেই যেটুকু রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁরা পেয়েছিলেন, সেটুকুকেও এই বিভাজন দূর করার কাজে লাগাননি, বরং বিভাজনটাই অস্বীকার করে গিয়েছেন, ভাবের ঘরে চুরি করেছেন। যেন সত্যি-সত্যি রাষ্ট্রীয় আর সামাজিক ভাবে কোনও ধর্ম-ভাগ নেই।

আর তাই কলকাতার মতো ‘কসমোপলিটান’ শহরেও মুসলমানরা আলাদা এলাকায় থাকেন। নতুন তৈরি হওয়া সল্টলেকে জমি বণ্টনে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা শতাংশের হিসেবেও আসে না। একটা জলজ্যান্ত সামাজিক সত্য থেকে কতখানি চোখ সরিয়ে থাকলে এটা সম্ভব হয়, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। অনুদান নয়, ভাতা নয়, নিজেদের অধিকারে এই রাষ্ট্রের, এই সমাজের সংখ্যালঘু মানুষ কিছু দাবি করতে পারেন, বামপন্থীরা নিজেরা যখন নীতি প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন, সে কথা মানতেন কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন